• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ক্রীড়াঙ্গনে ২০২০

করোনার আঘাত সয়ে ফিরেছে ফুটবল


ক্রীড়া প্রতিবেদক ডিসেম্বর ২৪, ২০২০, ০৪:৩৪ পিএম
করোনার আঘাত সয়ে ফিরেছে ফুটবল

ঢাকা : পুরো পৃথিবীকে তছনছ করে দেয়া মহামারি করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের কাছে কোণঠাসা গোটা মানবজাতি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হুহু করে বেড়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী চলছে অর্থনৈতিক মন্দা, বেড়ে চলেছে বেকারত্ব। করোনার ছোবলে বিপন্ন সবার স্বাভাবিক জীবন। তার প্রভাব পড়েছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও।

২০২০ সালে  করোনার কারণে বন্ধ হয়েছে একের পর এক ক্রীড়া আসর। দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলও এর হাত থেকে রেহাই পায়নি।

গত জুন-জুলাইয়ে হতে যাওয়া ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও কোপা আমেরিকার মতো জনপ্রিয় আসর এক বছরের জন্য পিছিয়ে গেছে। নতুন সূচিতে আগামী বছরের একই সময়ে হবে কোপা আমেরিকা ও ইউরো।  

ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে ইউরোপে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনাভাইরাস। গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ রোগকে মহামারি ঘোষণা করা হয়। মার্চের মাঝামাঝি প্রথমে ইউরো ও পরে কোপা আমেরিকা বন্ধের ঘোষণা আসে।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগসহ গত মৌসুমে ট্রেবল জয়ের আনন্দে ভেসেছে বায়ার্ন মিউনিখ

এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বন্ধ হয়ে যায় ইতালিয়ান সিরি এ। মার্চের মাঝামাঝিতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগও বন্ধের ঘোষণা চলে আসে। জার্মান ফুটবল লীগ (ডিএফএল) বন্ধ করে দেয় বুন্দেস লিগার সব ম্যাচ। ফ্রেঞ্চ লীগ ওয়ানের খেলাও মাঠে না গড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লীগের বেহাল দশা শুরু হওয়ায় ২০১৯-২০ মৌসুম ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়। একইসঙ্গে স্থগিত হতে থাকে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের একের পর এক ম্যাচ।

ফ্রান্সের করোনা পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে এপ্রিলের শেষে লীগ ওয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের ২০১৯-২০ মৌসুম বাতিলের ঘোষণা দেয়। পয়েন্ট টেবিলে এগিয়ে থাকায় পিএসজিকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতির ভয়ে এবং ফুটবলের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার যুক্তিতে যেকোনো মূল্যে খেলা মাঠে ফেরানোর বাকি লীগগুলোর চেষ্টা চলতে থাকে।

তিন দশক পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ জয়ের খরা কাটিয়েছে লিভারপুর

ফুটবলের প্রত্যাবর্তন : দীর্ঘ ২ মাস ৫ দিন স্থগিত থাকার পর গত ১৬ মে বুন্দেস লিগা দিয়ে আবারো ফুটবল মাঠে ফিরে আসে। ‘জৈব-সুরক্ষা বলয়’ নামক ‘বন্দিশালা’ তৈরি করে দর্শকভরা স্টেডিয়ামকে দূরে ঠেলে অচেনা রূপে শূন্য গ্যালারিতে ফুটবলে সেই পুরনো স্বাদ না থাকলেও অনেকের কাছে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ফুটবল মাঠে ফেরাটাই ছিল অনেক বড় পাওয়া। দুই ম্যাচ বাকি থাকতে আসরে টানা অষ্টমবারের মতো শিরোপা জেতে বায়ার্ন মিউনিখ।

বুন্দেস লিগার পর গত ১১ জুন মাঠে ফেরে লা লিগা। লীগ বন্ধের আগে রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে শিরোপার পথে এগিয়ে ছিল বার্সেলোনা। তবে করোনা পরবর্তী সময়ে বার্সা তাদের ছন্দ হারিয়ে ফেলে। জিনেদিন জিদানের দল টানা ১০ জয়ে শিরোপা জিতে নেয়।

গত ১৭ জুন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ মাঠে ফেরার পর সবচেয়ে বেশি আনন্দিত ছিল লিভারপুল। জুর্গেন ক্লপের দল লীগ মাঠে ফেরার পর প্রথম দুই রাউন্ডেই শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলে। ৭ ম্যাচ হাতে রেখে চ্যাম্পিয়ন হয় অলরেডরা।  

সবার আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিরি এ ফিরেছে সবার পরে। মৌসুমের শুরু থেকে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাওয়া ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাস করোনার পরেও ছন্দে ফিরতে পারেনি। তবে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে অপরাজিত লাজিও পরে আর ফর্ম ধরে রাখতে না পারায় দুই ম্যাচ হাতে রেখেই ট্রফি নিশ্চিত করে মাত্র ১ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে আসর শেষ করা তুরিনের বুড়িরা।

নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সিরিএ-তে ধরে রেখেছে জুভেন্টাস

ইউরোপের শীর্ষ ৫ লীগ ফেরার পর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগও শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগস্ট মাসে নতুন ফরম্যাটে ফেরা এই টুর্নামেন্টে হোম-অ্যাওয়ে পদ্ধতি বাদ দেয়া হয়। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে জৈব-সুরক্ষা বলয়ে শুন্য গ্যালারিতে এক লেগের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৪ আগস্ট শেষ আটের লড়াইয়ে ফুটবল বিশ্ব অবিশ্বাস্য এক ম্যাচের সাক্ষী হয়। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হয় পাঁচবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা। পরে ফাইনালে পিএসজিকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় বাভারিয়ানরা।

মৌসুম শেষের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শুরু হয়েছে ইউরোপের শীর্ষ ৫ লীগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ২০২০-২১ মৌসুম। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে প্রতি ম্যাচে দুই হাজার দর্শকের গ্যালারিতে খেলা দেখার অনুমতিও মিলেছে।

ক্লাব ফুটবলের পর করোনার ধাক্কা সামলে আন্তর্জাতিক ফুটবলও ফিরেছে। সেপ্টেম্বরে মাঠে গড়ায় উয়েফা নেশন্স লীগের দ্বিতীয় আসর। তিন মাসের গ্রুপ পর্ব শেষে নির্ধারিত হয় আগামী বছর হতে যাওয়া শিরোপা লড়াইয়ে চার ফাইনালিস্ট-ইতালি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও স্পেন।

অক্টোবরে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচও দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল প্রথম চার রাউন্ডের সবকটি জিতে ১২ পয়েন্ট নিয়ে তারা পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে আছে। তিন জয় ও এক ড্রয়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের দুইয়ে আছে আর্জেন্টিনা।

লা লিগায় ট্রফি ঘরে তুলেছে রিয়াল মাদ্রিদ

ফুটবলারদের ইনজুরির মিছিল : দীর্ঘ বিরতির পর ফুটবল ফিরে আসায় দর্শকদের মাঝে আনন্দ, স্বস্তি, উত্তেজনা ও উন্মাদনা খানিকটা ফিরে এলেও গত মৌসুম দেরিতে শেষ হওয়ায় নতুন মৌসুম আগামী বছরের মে মাসের মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকায় ফুটবলারদের চরম ব্যস্ত সূচিতে খেলতে হচ্ছে। ক্লাবগুলোকে সপ্তাহে গড়ে তিনদিন পরপর ম্যাচ খেলতে হচ্ছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সূচির ব্যস্ততা থাকায় কখনও কখনও খেলোয়াড়দের সাত দিনে তিনটি ম্যাচেও মাঠে মানা লাগছে। আর তাতে করে বেড়েই চলেছে ইনজুরি আক্রান্ত খেলোয়াড়ের সংখ্যা। দলীয় পারফরম্যান্সেও তার নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোচদের অনেক সময় দ্বিতীয় সারির দল নিয়েই প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে হচ্ছে। স্কোয়াডে খেলোয়াড়ের ঘাটতি পূরণ করতে দলের ফুটবলারদের টানার ঘটনাও ঘটছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি : ফিফা কমিটির প্রধান অল্লি রেনের উদ্ধৃতি দিয়ে গত সেপ্টেম্বরে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর বিশ্বব্যাপী শুধু ক্লাব ফুটবলেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, যা মোট আয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

প্রায় প্রতিটি ক্লাবেরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সব ক্লাবেরই বেতন কাটার পথ বেছে নিতে হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোচিং স্টাফদের চাকরি হারানোর অনেক ঘটনাও ঘটেছে।
গত মে মাসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের অন্যতম ধনী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের ২ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড ক্ষতি হয়েছিল বলে জানায়। মৌসুম শেষে অংকটা আরও বড় হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল তারা।

অক্টোবরে বার্সেলোনা জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর দেয়ার পর তাদের মোট ক্ষতির পরিমাণ ৯ কোটি ৭০ লাখ ইউরো।

ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার  রবার্ট লেভানডভস্কি

ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার লেভানডভস্কি : ২০২০ সালে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন রবার্ট লেভানডভস্কি। ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফার সদর দপ্তর থেকে গত বৃহস্পতিবার ‘দ্য বেস্ট ফিফা ফুটবল অ্যাওয়ার্ড’বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে ‘দ্য বেস্ট ফিফা মেনস প্লেয়ার’ নির্বাচিত হন বায়ার্ন মিউনিখের এই ফরোয়ার্ড।

লিওনেল মেসি

অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার লড়াইয়ে ছিলেন লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো দুই মহাতারকাও। কিন্তু ২০১৯-২০ মৌসুমে বলতে গেলে লেভানডভস্কি ছিলেন সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বায়ার্নের ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ে তিনি ১৫ গোল করে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। একই মৌসুমে দলটিকে বুন্দেস লিগা ও জার্মান কাপ এনে দেন এই পোলিশ স্ট্রাইকার। দলের হয়ে ট্রেবল জিততে লেভানডভস্কি গোল করেন ৫৫টি। ৩২ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার সব প্রতিযোগিতা মিলে ইউরোপের সেরা পাঁচ লীগের যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে গত মৌসুমে ১৬টি গোল বেশি করেছেন।

বুন্দেস লিগার চলতি মৌসুমে ১১ রাউন্ড শেষে গোলদাতাদের তালিকায় শীর্ষেই আছেন তিনি। গত ৪ অক্টোবর হের্টা বার্লিনের বিপক্ষে বায়ার্নের ৪-৩ ব্যবধানের রোমাঞ্চকর জয়ে দলের চারটি গোলই করেছিলেন এই ফুটবলার।

দীর্ঘ এক দশক ধরে দাপট দেখানো এই দুই মহাতারকা রোনালদো ও মেসিকে স্পষ্ট ব্যবধানেই পেছনে ফেলেছেন লেভানডভস্কি। মোট ৫২ ভোটিং রেটিং পয়েন্ট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। মেসি-রোনালদোর কেউই লেভানডভস্কির সঙ্গে জমাট লড়াই করতে পারেননি।

বিশ্বজুড়ে ফিফা সদস্যভুক্ত ফুটবল ফেডারেশনগুলোর জাতীয় দলের কোচ, অধিনায়ক, প্রতিটি দেশের একজন করে নির্বাচিত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং দর্শক ফিফা বর্ষসেরা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। প্রত্যেকেই আলাদাভাবে ভোট দিয়েছেন। প্রতিটি ক্যাটাগরিতেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন লেভানডভস্কি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

 

Wordbridge School
Link copied!