ঢাকা: করোনার বছরটা বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে।দল, সরকার এবং মহামারি তিন দিকে সমন্বয় করে এগিয়ে যাওয়াটা মোটেও সহজ ছিলো না।তবে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সাহসীকতা, দৃঢ় মনোবল এবং সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে এই কঠিন পরীক্ষা বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছে আওয়ামী লীগ।
এদিকে করোনার কারণে সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ না থামলেও নিরুত্তাপ রাজনীতি এখনও কিন্তু পুরোপুরি সচল হয়নি।তেমনভাবে হচ্ছে না সভা-সমাবেশ।নেই বিক্ষোভ-মিছিল!করোনাকালে স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি উপনির্বাচনে কিছুটা উত্তাপ ছড়ালেও পুরো বছরই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়নি রাজনীতি। সীমাবদ্ধ ছিল ভার্চুয়াল মাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমে পাঠানো বক্তৃতা-বিবৃতিতেই।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর প্রথম যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি। ওই দিন সভা মুলতবি রাখা হয়। পর দিন গণভবনে আবার সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১০ জানুয়ারি মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য ক্ষণগণনার কর্মসূচি শুরু করা হয়। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর জমকালো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলতে থাকে আওয়ামী লীগের।
মুজিববর্ষে জাতীয় উদযাপন কমিটির অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে দলীয় কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়। এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি চলবে বছরজুড়ে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে স্মরণিকা প্রকাশ করার কথা বলা হয়। এছাড়া দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত, ‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’-এমন ঘোষণাকে দলীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানান ওবায়দুল কাদের। পরবর্তীতে দলের কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি দেয় ১৪ দল।
এর মধ্যে জানুয়ারিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি ভোট নিয়ে সাংগঠনিক ব্যস্ততায় বছর শুরু করে দলটি।ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আতিকুল ইসলাম এবং দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। জানুয়ারি মাস জুড়েই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দুই মেয়র প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারণা চালান। ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটে দুই প্রার্থীই জয় লাভ করেন।
নির্বাচনের পর সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে কর্মসূচি নেয় ক্ষমতাসীন দলটি। এর অংশ হিসেবে নেয়া হয় বেশ কিছু কর্মসূচি। এ সময় সম্মেলন সম্পন্ন হওয়া ইউনিটগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের তাগিদ দেয় দলটি। পাশাপাশি জেলাগুলোর অসমাপ্ত সম্মেলন শেষ করা, সাংগঠনিক সফর, সদস্য সংগ্রহ অভিযান, প্রতি জেলার কমপক্ষে দু’জন প্রবীণ নেতাকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সংবর্ধনা দেয়া, জেলা-উপজেলায় বর্ধিত, প্রতিনিধি ও কর্মীসভা সম্পন্ন করারও নির্দেশনা দেয়া হয়।
সবকিছু যখন পরিকল্পনা মাফিক চলছিলো ঠিক তখনই সতর্ক বার্তা আসে চীনের উহান থেকে।ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস।বাংলাদেশেও এসে পরবে যে কোনো সময়। সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে করোনা ঠেকাতে, সেইসঙ্গে আক্রান্ত হয়ে গেলে পরিস্থিতি মোকাবেলার পরিকল্পনা সাজাতে।
এরপর ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম আঘাত আসে। ২৬ মার্চ দেশজুড়ে লকডাউন দেয়া হয়। লকডাউনে চার মাস আওয়ামী লীগের কোনো দৃশ্যমান রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। শেখ হাসিনার নির্দেশে যা ছিল; তা হলো দেশের জনগণের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। করোনার কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড না হলেও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী বছরব্যাপী সক্রিয় ছিল মানবতার কল্যাণে।ঘরবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হয়। বিনামূল্যে মাস্ক, স্যানিটাইজারসহ করোনা প্রতিরোধমূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নিজ নিজ এলাকায় সচেতনতা ও সতর্কতামূলক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোও এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
করোনা দুর্যোগে দলের পক্ষ থেকে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তাসহ প্রায় ১০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা দেয়া হয়। ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ উপকমিটির উদ্যোগে সারাদেশের সব জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হয়। সভানেত্রীর নির্দেশে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি নগদ সহায়তা, ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, টেলিমেডিসিন, লকডাউন এলাকায় রাতে খাবার পৌঁছানো, ইফতার ও সেহরি বিতরণ, সবজি বিতরণসহ কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলে দেয়া হয়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, কেন্দ্রীয় নেতা ‘জনতার মেয়র’ খ্যাত সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হাজী মকবুলসহ ৬ শতাধিক নেতা-কর্মী।
করোনার কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে বের না হলেও কেন্দ্রীয়, জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রেখেছেন। ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। মাঠের কর্মসূচি না থাকলেও বিষয়ভিত্তিক ভার্চুয়াল সভা করছে আওয়ামী লীগ। দলের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা করোনার মধ্যে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
করোনার আঘাতের মধ্যেই আবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বন্যা দেখা দেয়। সে সময়ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী অসহায় মানুষকে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা করে। এর মধ্যে দেশের ৫০ লাখ মানুষকে আড়াই হাজার করে টাকা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় অসহায় গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করেও দেয়া হয়।
করোনা পরিস্থিতিতে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও সীমিত কর্মসূচিতে পালিত হয়। এ ইস্যুতে বেশকিছু ওয়েবিনার করে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক। ৩ অক্টোবর সীমিত আকারে দলের কার্যনির্বাহী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন সম্মেলনের ১০ মাসের মাথায় আট বিভাগে নেতাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর সাংগঠনিক নেতারা নিজ নিজ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন। এর ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন সম্পন্ন হয়।
এর মধ্যেই পৌর নির্বাচনে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামেন নেতারা। বছরের শুরুতেই ভোট ও সম্মেলন, শেষ দিকে পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই, জেলা-উপজেলা সম্মেলনে দল গোছানোর মধ্যে সক্রিয় কেন্দ্রীয় নেতারা। পাঁচটি উপনির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে হয়েছে চলতি বছর।
মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের নতুন মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রবীণ রাজনীতিক আমির হোসেন আমুকে। চলতি বছরে জাতীয় সংসদের নিয়মিত ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশনেও সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অধিবেশনের আগে সবাইকে বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষা করা হয়। কোরাম পূরণে যত জন এমপি প্রয়োজন সেভাবেই ডাকা হয় অধিবেশন। অনেক প্রবীণ নেতা ছিলেন ঘরবন্দী।
করোনার মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদকাণ্ডে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশেরকারীদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এরপরই দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ও দলের নাম ভাঙিয়ে সুবিধাবাদী এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যায় আওয়ামী লীগ।এছাড়া বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে জোর দেয়। দলীয় কোন্দলের কারণে গত ১৯ নভেম্বর নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সাংগঠনিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি বিভিন্ন নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এরআগে আওয়ামী লীগের ৫ সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবকলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষকলীগ এবং যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে। এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
বছরের শেষ দিকে আসে ভাস্কর্য ইস্যু।সভা-সমাবশে-বক্তৃতায় টালমাটাল হতে শুরু করে রাজনীতির মাঠ।এরমধ্যে কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। প্রতিবাদে রাজপথে সক্রিয় হন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।শুরুতে ভাস্কর্য বিতর্ককে হালকাভাবে নিলেও পরে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভাস্কর্য নিয়ে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা, আইনগত পদক্ষেপ এবং প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদদের মতামত তুলে ধরে জনমত গঠন করে আপাতত বিতর্কের অবসান করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।
সোনালীনিউজ/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :