ঢাকা : প্রতিদিনই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যাতায়াত করছে হাজার হাজার মানুষ। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীতেও দেশের তিন দিক জুড়ে ভারতের সীমান্ত থাকায় এই যাতায়াত ঠেকানো যায়নি। এরই মধ্যে সীমান্তের ২৯ জেলায় বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ।
বিশেষ করে যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা বেশি। কিন্তু এভাবে বাড়তে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে আংশিকভাবে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, এই ধরনের ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়ায়। তাই ভারত থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে চালক ও সহকারীরা বিপজ্জনক ভারতীয় ধরনের করোনাভাইরাস বহন করে আনার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে দেশের করোনা পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
তাছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতা কমছে। আর ঈদের ছুটির পরপরই সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনা সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এরইমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে উদ্বেগজনক হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় সোমবার (২৪ মে) থেকে আগামী সাত দিন বিশেষ লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক দিনের মধ্যে সীমান্তবর্তী আরো কয়েকটি জেলা সর্বাত্মক লকডাউনে আনার চিন্তা করছেন কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ঈদের ছুটির আগেই দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছিল। এই ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি বলে বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন।
তারা এও বলেছিলেন, ঈদের ছুটির পর ভারতীয় ধরনের কারণে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। সরকারি তথ্যে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে নমুনা পরীক্ষাও বেড়েছে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, অবৈধভাবে ভারত থেকে মানুষ আসা বন্ধ না হওয়া দেশের জন্য বিপজ্জনক। যে কোনো সময় দেশে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের পূর্ণ সংক্রমণ শুরু হতে পারে। আর সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
মহাদুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে শিগগির সীমান্তে সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, ভারত থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের অনেকের শরীরেই সংক্রমণ ধরা পড়ছে। অধিক সংক্রমণশীল ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের রোগীও পাঁচজন শনাক্ত হয়েছেন। তাই সীমান্তে এখনই কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সমপ্রতি সাতক্ষীরায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা ভারতফেরত ১৩৯ জন পাসপোর্টধারী যাত্রীর মধ্যে ১১ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ভারতে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সমপ্রতি একজন ভারতীয় নাগরিক অবৈধ পথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তার শ্বশুরবাড়ি বেনাপোলে। পুলিশ তাকে আটক করে বেনাপোলের একটি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে।
জানা গেছে, বৈধ স্থলবন্দর ছাড়াও দুই দেশের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এর সব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নেই। এখনো অনেক এলাকা আছে, যেখানে একটি বাড়ির ভেতর দিয়ে সীমান্তরেখা গেছে। এসব পথ দিয়ে অবৈধভাবে দৈনিক বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশে প্রবেশ করে।
সমপ্রতি যশোরের একটি স্থলবন্দর দিয়ে বৈধভাবে এক দিনে চারজন দেশে প্রবেশ করেছেন। একই দিন ওই এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করে ৩০ জন।
এদিকে বিদেশ থেকে যারা দেশে আসছেন, তাদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কিন্তু বৈধভাবে যারা ভারত থেকে আসছেন, তাদের মধ্যে যারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা নীতি-আদর্শের কথা বলেন, তারাই নিয়ম মানেন না। ভারত থেকে অবাধে মানুষ আসার পাশাপাশি ঈদ-পরবর্তী ফিরতি যাত্রায়ও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। ১০ থেকে ১২ বার গাড়ি বদল করে ঢাকায় ফিরছেন অনেকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত দিয়ে অবৈধ যাতায়াত কীভাবে ঠেকানো যাবে তা আমরা জানি না। ভারত থেকে অবৈধভাবে আসছে মানুষ। সামনে মহাদুর্যোগ হতে পারে। ভারতে করোনার ভয়াবহ অবস্থা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়লে কী অবস্থা হবে তা কল্পনা করা কঠিন। এমন অবস্থায় সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, নিজের জীবন নিজেকে বাঁচাতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, ঈদের ছুটির আগেই দেশের সীমান্ত এলাকায় করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছিল। এই ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
আর যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে এই জেলাগুলোতে সংক্রমণ কিছুটা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এই জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেশি হওয়ার সঙ্গে ভারতে যাতায়াতের একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। অবৈধভাবে ভারত থেকে মানুষ আসা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ। সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর আমরা নজর রাখছি।
পরিস্থিতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, তা বুঝতে আরো সপ্তাহখানেক সময় লেগে যাবে। সীমান্ত বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে মানুষ আসা বন্ধ না হলে সামনে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিশেষ লকডাউন : ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এক সপ্তাহের জন্য বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ গতকাল সোমবার দুপুরে তাঁর কার্যালয়ে প্রেস বিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন।
লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও যানচলাচল বন্ধ থাকবে। রাজশাহী ও নওগাঁ থেকে কোনো যানবাহন চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করতে পারবে না, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেও কোনো যানবাহন জেলার বাইরে যাবে না। রোগী ও অন্য জরুরি সেবাদানকারীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।
জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, আমের বাজার বসবে। তবে সেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবে। আম পরিবহনের ক্ষেত্রে বাগান থেকে আম ট্রাকে করে পরিবহন করা যাবে, সেই সঙ্গে কুরিয়ারের মাধ্যমে আম পরিবহন করা যাবে। কলকারখানা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে ঢাকায় একজনের মৃত্যু : রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিন দিন আগে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই রোগী অন্যান্য রোগের পাশাপাশি মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন।
মঙ্গলবার (২৫ মে) সকালে বারডেম হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন গণমধ্যমে বলেন, তিন দিন আগে ৬৫ বছর বয়সী একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই রোগীর অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস ছিল। তার কিডনির সমস্যা ছিল। তিনি কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছিলেন। চিকিৎসার সময় বোঝা যায়নি যে, তিনি মিউকোরমাইকোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর পর এটা জানা গেছে।
তাছাড়া ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত একজন রোগী এখনো বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শনাক্ত হওয়া আরেকজন রোগী অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন।
অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভর্তি থাকা রোগীর পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়। তাকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ওষুধের দাম অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওষুধের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয়েছে।
রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে বারডেম হাসপাতালের একটি কেবিনে ৫৫ বছর বয়সী এই রোগীর চিকিৎসা চলছে। রোগীর বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। প্রায় এক মাস আগে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি যান। কিন্তু আবার জ্বর দেখা দিলে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন এবং সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বারডেমে নেওয়া হয়।
অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, রোগী চার-পাঁচ বছর ধরে ডায়বেটিসে ভুগছেন। এরপর তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বর ও কাশি কমে না যাওয়ায় চিকিৎসকেরা তাকে যক্ষ্মার ওষুধও দিয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত।
অণুজীববিজ্ঞানী বলছেন, মিউকোরমাইকোসিস নতুন কোনো ছত্রাক নয়। এই ছত্রাক পরিবেশেই আছে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস থাকে তাদের ঝুঁকি বেশি। আবার স্টেরয়েড গ্রহণ করা কোনো কোনো ব্যক্তিও এতে আক্রান্ত হতে পারেন।’
মিউকোরমাইকোসিস ছোঁয়াচে নয়। শরীরের যেকোনো স্থানে এর সংক্রমণ হতে পারে। নাকের আশপাশে, চোখে সংক্রমণ বেশি হয়। চোখে সংক্রমণ হলে তা দ্রুত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত এলাকায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ওই এলাকা কালো হয়ে যায়। তাই একে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বলা হয়।
ভারতে মিউকরমাইকোসিস বা ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮০০ জন এই ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :