• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

থমকে আছে দেশের রাজনীতি


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৩, ২০২১, ১০:৩৩ এএম
থমকে আছে দেশের রাজনীতি

ঢাকা : করোনা সংক্রমণ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, এরশাদহীন ‘নিষ্ক্রিয়’ জাতীয় পার্টি, হেফাজতে ইসলাম ইস্যু, জামায়াতে ইসলামের নিষ্ক্রিয়তা এবং সারা দেশে দ্বিতীয় দফা লকডাউনসহ নানা কারণে বিগত দুবছর ধরে থমকে আছে দেশের রাজনীতি।

বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দেশটির জন্মের ইতিহাস, বিদ্যমান সরকারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং মানুষের রাজনীতিমনস্কতা কেন্দ্র করে আবর্তিত। ১৯৭১-এ অস্থায়ী সরকার গঠন এবং অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু জনবান্ধব রাজনৈতিক মাঠ আজো গড়ে ওঠেনি।

রাজনৈতিক দলগুলোর জনসম্পৃক্ত দৃশ্যমান কর্মসূচি নেই বললেই চলে। ওয়ান ইলেভেন (১/১১) পরবর্তী সরকার আওয়ামী লীগের বিপক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি। যদিও চলতি বছরের শুরুতে কয়েকটি ইস্যু নিয়ে বিএনপি মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হঠাৎ অসুস্থায় তাও থমকে গেছে।

অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোরে রাজনৈতিক প্রভাব না থাকায় মাঠ পর্যায়ে নিজেদের জৌলুস হারাতে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক কূটকৌশল দূরে ঠেলে সর্বত্র ক্ষমতা ও পেশিশক্তি ব্যবহার করছেন নেতাকর্মীরা। এতে মাঠ পর্যায়ে দলটির প্রতি জনমনে নেতিবাচাক প্রভাব সৃষ্টি হলেও কৌশলে সব কিছু শক্ত করে ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। আওয়ামী লীগের অবস্থান ধরে রাখতে মাঠ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। এ অবস্থায় প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিসহ অন্যান্য সকল দলের কর্মকাণ্ড সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে। তারা মাঝে মাধ্যে দু-একটি বক্তব্য দিয়েই নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কাটার কোনো আশা দেখছেন না তারা। যদি কোনো চাপের কারণে সংকট কেটেও যায়, তা হবে সাময়িক। সংকট আবারো ফিরে আসবে বলে মনে করছেন তারা।  

কারণ, রজনৈতিক দলগুলোই সংকটের কারণ। তারাই সংকট চায়। সংকট টিকিয়ে রাখে তাদের স্বার্থে। সমসাময়িক রাজনীতির বিশ্লেষক আফসান চৌধুরীর মতে, বর্তমান রাজনীতিতে এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজির অর্থে পরিচালিত হয়। চাঁদাবাজির জন্য ক্ষমতা একটি মোক্ষম অস্ত্র।

তাই যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখা তাদের প্রধান লক্ষ্য, জনগণ তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় না। যে যার অবস্থানে আপোষহীন থাকে। তাছাড়া রাজনীতিতে ব্যবসায়ী বা আমলাদের প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এরা যখন সিদ্ধান্ত নেন তারা তাদের স্বার্থে নেন। জনগণের কথা ভাবেনন। যারা ভাববেন সেই প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখন গৌণ। এই রাজনীতির সঙ্গে দেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের মানুষ এই রাজনৈতিক আদর্শ ধারণও করেন না।

তিনি বলেন, কোনো দলের রাজনীতিই আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রক এখন সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি এবং বিত্তশালীরা। আর সাধারণ মানুষও রাজনীতিতে নেই। তাদের গুরুত্বও নেই। ফলে যা হবার হয়েছে। রাজনীতি চলে গেছে রাজনীতিবিদদের হাতের নাগালের বাইরে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ এই রাজনীতিকদের ডাকেও মাঠে আসতে চাইছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শামীম রেজা মনে করেন, বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রাধান্য রাজনীতিতে নগন্য।

তবে আমরা গত দুই-তিনটি সংসদের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখবো যারা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে আছেন তাদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন। আছেন আমলারা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পেশাজীবী ছাড়া জনসম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব নয়। দল ও নেতাদের ভালোবাসা থেকেই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মাঠ পর্যায়ে মুহূর্তে লাখো মানুষ জড়ো করা সম্ভব।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীবিদ হওয়া, দীর্ঘদিন আমলা থেকে বা কোনো বাহিনীতিতে কাজ করে রাজনীতিতে অল্প সময়ে প্রভাবশালী হওয়া কোনো ভালো লক্ষণ নয়। রাজনীতিবিদরা যে রাজনীতি পরিচালনা করার কথা সেটা না থাকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত নয়। আমার মনে হয় এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করবে। এতে ক্রমান্বয়ে রাজনীতির মাঠ জনসম্পৃক্তহীন হয়ে পড়তে পারে।

রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে হতাশ হবার কিছু নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, সবকিছুই দ্রুত সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। সরকার যতই উন্নয়নের ঢোল পেটান, সফলতার কথা বলে বেড়ান, প্রকৃতপক্ষে এ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তাদের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন নেই। জনণের ভোটে তারা নির্বাচিত নন।

তা ছাড়া, সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করলেই সফল বলা যাবে না। এই সরকার নৈতিকভাবে ও টেকনিক্যালি কোনো বৈধ সরকার না। তারা বৈধতা পাবার যতই চেষ্টা করুক তাতে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১২/১৪ বছর ক্ষমতায় থাকাটাকে সফল বলা যাবে না। তারা চাইছেন দমন পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলের সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের নিষ্ক্রিয় করতে।

তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া যে মাপের নেত্রী তার ভাগ্য আদালত কিংবা একটি নির্বাহী আদেশ বা কোনো কলমের খোঁচায় নির্ধারিত হয় না। সেরকম চেষ্টা ওয়ান ইলাভেনের সময়ও দেখা গেছে কিন্তু তারা সফল হননি।

যখন খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীকে রাজনৈতিক মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় তখন বুঝতে হবে যে, বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সরকারের সবকার্ড শেষ হয়ে গেছে। সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই বেগম জিয়াকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে।

কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে বিএনপিসহ ২০ দলই লাভবান হয়েছে। একইসঙ্গে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মতে রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় আমরা হতাশ নই। ভালো রাজনীতির সুদিনের পূর্বাভাস এটি। দ্রুত রাজনীতির ময়দানের এই কালো মেঘ কেটে যাবে। রাজনীতিতে সুদিন আসবেই।

সরকারে দমনপীড়ন ও মামলা বিএনপিকে বেশি ক্ষতি করতে পারবে না দাবি করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এতে দলীয় নেতাকর্মীরা আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। প্রায় ১২ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। দীর্ঘ দিন কারাগারে  ছিলেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে আরো মামলা আছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার অসুস্থা থেকে সুস্থ করে তুলতে দালের নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত রয়েছেন।

তা ছাড়া দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে তারেক রহমানেরও দেশে ফেরার পরিস্থিতি নেই। আর করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ নানা সংকটে রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতির বর্তমান শান্তভাবে থেকে হতাশ হাবার কোনো কারণ নেই।  

আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের কর্মীবাহিনী, জনগণ এগুলো উপেক্ষা করে মোকাবিলা করে তারা আমাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য সে লক্ষ্যে তারা পৌঁছুতে পারবে।

২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট-সমাঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, তারা এখন আর কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ নেই। দেশ ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় কখনোই আপস করছে না। জাতীয় পার্টি কারো দয়া বা ভিক্ষার রাজনীতি করে না। কারো করুণা নয়, সম্মানের জন্য রাজনীতি করছে জাতীয় পার্টি।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হতে থাকে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে আমাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে। তার আগে আওয়ামী লীগ দুর্বল থাকলেও এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সুপার পাওয়ার হয়ে গেছে।

বিএনপিও অনেক দিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি আরো বেশি সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে দুর্বল হয়েছে।

আগামী দিনের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠবে। পরিচ্ছন্ন ইমেজের জন্য দেশের মানুষ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে আছে। জাতীয় পার্টি নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে মাঠে আছে। নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে এগিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তাই  দ্রুতই রাজনীতির মাঠে জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়াবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!