ঢাকা : চলতি জুন মাসেই করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়ায় এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা। সতর্কতা হিসেবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো পর্যায়ক্রমে লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে সাতক্ষীরা জেলা। আগের দিন রাজশাহীকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত একদিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৭২৪ জনের। নতুন শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬৮৭ জন। আর মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ লাখ ৫ হাজার ৯৮০ জন।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে ৯ জন। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫ জন, রাজশাহীতে ২, পাবনা ও নওগাঁয় ১ জন মারা যান।
এ ছাড়া ১ জুন ও ২ জুন নতুন করে করোনায় শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৯৮৮ জন; যা গত এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল দুই হাজার ১৭৭ জন নতুন করে সংক্রমিত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩১ মে একদিনে এক হাজার ৭১০ জন রোগী নতুন করে শনাক্ত হন। তাদের নিয়ে দেশে করোনাতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে যায়।
গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হবার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়ায়। এরপরের ৯৯ দিনে আরো এক লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ার মাধ্যমে গত ২৯ মার্চ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়ায়। মধ্য মার্চে রোগীর সংখ্যা বেড়েছিলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ অভিহিত করা হলেও চিকিৎসকরা ‘করোনা সুনামি’ বলে আখ্যা দেন। আর এই ‘সুনামি’র মধ্যেই মাত্র ১৬ দিনে আরো এক লাখ মানুষ শনাক্ত হবার মাধ্যমে গত ১৪ এপ্রিল শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাত লাখ ছাড়ায়।
এরই মধ্যে গত ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। এরপর সাত লাখ থেকে আট লাখ রোগী শনাক্ত হতে সময় লেগেছে ৪৭ দিন। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে রোগীর সংখ্যা কমে এলেও আবার সেটা বাড়তে শুরু করেছে।
ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা ও যাতায়াতে বিপুল লোকসমাগম দেখে জনস্বাস্থ্যবিদরা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর বেশ কয়েকবার আশঙ্কা করেছিল, ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। এখনো সেভাবে সংক্রমণ না বাড়লেও ঈদের পর থেকে ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা রয়েছে।
এদিকে ভারত সীমান্তবর্তী ১৫টি জেলায়ও রোগী দ্রুত বাড়ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আবারো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবারো দেশে সংক্রমণ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের ১১ জেলায় উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে এমন রোগী পাওয়া গেছে যাদের ভারত ভ্রমণের ইতিহাস নেই। অর্থাৎ দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের সময়ে মানুষের অবাধ চলাচল, সম্প্রতি মাস্ক ব্যবহারে আবার মানুষের অসচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব না মানা এবং বিশেষ করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণের কারণে জুন মাসে করোনা আবার ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, শনাক্ত হারের বিপরীতে বর্তমানে দেশের ১১ জেলায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি গত ১ জুন তাদের বৈঠকে করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মনে করেন তারা।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ( রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট) এলাকায় সংক্রমণের উচ্চহার দেখা গেছে। এ ছাড়া আরো কিছু জেলাতে উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে। কমিটির এক সূত্র জানায়, এ আট জেলা ছাড়াও সিলেট, কক্সবাজার ও ফেনীতেও সংক্রমণের উচ্চহার রয়েছে।
এদিকে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় দেশের প্রথম জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর রাজশাহী ও নওগাঁকে বুধবার লকডাউনের আওতায় আনা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে।
সূত্র বলছে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণও হয়েছে। আর এটা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তাই অবস্থা বিবেচনায় সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই এবং এতে জনপ্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সারা দেশে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালন করতে হবে জানিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা ও উচ্চ সংক্রমিত এলাকায় সম্পূর্ণ লকডাউন দেওয়া জরুরি বলে সুপারিশ করে কমিটি।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লা বলেন, ‘কমিটি মনে করে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের বিধিনিষেধ পালনে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
একই সঙ্গে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে কঠোর মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন জানিয়ে অধ্যাপক সহিদুল্লা বলেন, ‘দরকার হলে এ বিষয়ে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে আইন সংশোধন করা যেতে পারে। একইসঙ্গে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত বিধিনিষেধের প্রয়োগ অব্যাহত রাখা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও জানান অধ্যাপক সহিদুল্লা।’
এতদিন যে কৌশল নেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল ‘স্ট্র্যাটেজি অব প্রিভেনশন’ কিন্তু সেখানে অনেক হেলাফেলা ছিল মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন ভিন্ন পথে আগাতে হবে।’
‘এখন দেশকে রেসকিউ করার কৌশল নিতে হবে। জাহাজ ডুবে গেছে, সেখান থেকে জাহাজকে তুলতে হবে, এখন আর আমরা প্রিভেনশন স্টেজে নেই’ বলেন তিনি। তার মতে, ‘সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত ছিল সবকিছুতে।
আর এসব কারণেই আশঙ্কা করছি, জুন মাসে দেশে খুব মারাত্মক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণসহ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানাই হবে এর অন্যতম কারণ।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ হাছান চৌধুরী মারুফ বলেন, ‘উহানে যখন সংক্রমণ শুরু হলো আমরা সবাই মনে করেছিলাম এটা চীনের বাইরে আসবে না, কিন্তু সেটা মহামারী হয়েছে।
বিশ্বে করোনাভাইরাসে ইতোমধ্যেই ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭০ জন মারা গেছে। বিশ্ব থেমে গেছে এই করোনার কারণে। ঠিক সেভাবেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবস্থাও একই রকম। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র, এই বিস্ফোরণ থামানো যাবে না।’
‘সংক্রমণ বাড়বে, বাড়ছেই’ মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘তবে এবার প্রথমে পেরিফেরিতে (মফস্বলে) বাড়ছে, ঢাকায় হয়তো পরে বাড়বে। এটা আমাদের আগেই আশঙ্কা ছিলই। আমরা যেরকম আশঙ্কা করেছিলাম সেরকম করেই বাড়ছে। তবে আমাদের ধারণা ছিল জুনের শেষে বা জুলাইয়ে বাড়বে। কিন্তু এখন তার আগে থেকেই শুরু হলো’-বলছিলেন অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :