ঢাকা : বিশ্বকে এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে কীভাবে সংক্রমণ ঠেকানো যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের হাজারো চেষ্টার পরও বিভিন্ন দেশে অবিশ্বাস্যগতিতে নতুন নতুন ধরনে এই ভাইরাস সংক্রামণের হার বাড়ছে। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ। এদের কেউ সুস্থ হচ্ছে আবার কেউ মারাও যাচ্ছে। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে রোগীর চাপে।
এর মধ্যে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। আর করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং (বিশ্লেষণের) ৮০ শতাংশ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া দিন দিন বাড়ছে উদ্বেগ।
শুক্রবার (৪ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টা আরো ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে নতুন শনাক্ত হয়েছে আরো এক হাজার ৮৮৭ জন। বর্তমান অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে জনগণের অবাধ চলাফেরায় নতুন করে ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) কারোনাভাইরাস সংক্রামণ তীব্র আকারে ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের।
রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস-র (আইদেশি) যৌথ গবেষণায় জানানো হয়, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের পর ৮০ শতাংশের দেহেই ভারতীয় (ডেল্টা) ধরন শনাক্ত হয়েছে।
শুক্রবার (৪ জুন) আইইডিসিআর ও আইদেশি-র প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকোয়েন্স বৈশ্বিক ডাটাবেজ জিআইএসএআইডিতেও জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট)-এর কমিউনিটি সংক্রমণ পর্যবেক্ষণে উচ্চ সংক্রমিত এলাকায় নিয়মিত করোনা আক্রান্ত রোগীদের কেস ইনভেস্টিগেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং সন্দেহজনক রোগীদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করছে আইইডিসিআর।
গত ১৬ মে আইইডিসিআর কর্তৃক বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের শনাক্ত সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আইইডিসিআর ও আইদেশি এ পর্যন্ত ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে।
এর মধ্যে ৪০টি (৮০ শতাংশ) নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, আটটি (১৬ শতাংশ) নমুনায় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হতে সংগৃহীত ১৬টি নমুনার ১৫টিতে, গোপালগঞ্জে সাতটি নমুনার সবগুলোতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।
এছাড়া, খুলনা শহর হতে সংগৃহীত তিনটি নমুনার সবগুলোয়, ঢাকা শহরের চারটি নমুনার দুটিতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় আগত সাত জনের দেহে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে ভারত থেকে আগত তিন জন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা ও খুলনায় চিকিৎসাধীন আছেন।
করোনার ধরনের জিনোম সিকুয়েন্সিং করা ৫০ রোগীর মধ্যে তিন জনের বয়স অনূর্ধ্ব ১০ বছর, সাত জনের বয়স ১০-২০ বছর, ২১-৩০ বছর বয়স ১০ জনের, আট জনের বয়স ৩১-৪০ বছর, আট জনের বয়স ৪১-৫০ বছর এবং চার জনের বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। এদের মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ২৬ জন নারী।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে আট জনের ভারত ভ্রমণের ইতিহাস আছে এবং ১৮ জনের বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। অপর ১৪ জনের বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের অথবা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ বিদ্যমান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাসহ অন্যান্য জেলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংক্রমণের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে এবং দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার অন্যান্য ধরনের বিস্তার রোধে জনসাধারণকে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর।
দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট রোধে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে লকডাউন চললান। এসব এলাকায় অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধের জন্য কঠোর নজরদারির এবং টহল বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কোডিভ-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, দেশের সার্বিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাতে সংক্রমণ উচ্চহারে বেড়েছে। এছাড়া আরো কিছু জেলায় উচ্চ সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি বাড়লে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যেমনটি বিভিন্ন উন্নত দেশে দেখা গেছে।
সাম্প্রতিককালে ভারত এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নাই এবং এতে জনপ্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ জন্য কমিটির পক্ষ থেকে সীমান্তের জেলাগুলোতে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধের জন্য কঠোর নজরদারি ও টহল বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখারও পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, কমিউনিটি পর্যায়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যাওয়ায় বড় আকারে সংক্রমণ হলে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। যেমন অনেক উন্নত দেশে দেখা গেছে। পাশের দেশ ভারত এখন এইরকম চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চিহ্নিত এলাকাগুলোতে কাঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প পথ নেই বলে মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, কারিগরি পরামর্শক কমিটির অনেক সুপারিশ এর মধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। নির্দেশনা দেওয়াই রয়েছে যে, স্থানীয় পর্যায়ে পরিস্থিতি দেখে স্থানীয় প্রশাসন নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তাদেরকে সেই ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কারিগরি কমিটি তো এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে বলেছে, যেখানে যেরকম করোনা পরিস্থিতি, সেরকম দেখে ওখানকার স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবেন, এই স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে যা যা কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ সব কাজই করতে পারবেন।
অন্যদিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১২ হাজার ৭৫৮ জনে। একই সময়ে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরো ১ হাজার ৮৮৭ জন। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ লাখ ৭ হাজার ৮৬৭ জনে।
শুক্রবার (৪ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে উঠেন এক হাজার ৭২৩ জন। এ নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠা রোগীর সংখ্যা সাত লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৮ জন। এ পর্যন্ত সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৫১ শতাংশ। মৃত ৩৪ জনের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছরের এক জন, বিশোর্ধ্ব এক জন, ত্রিশোর্ধ্ব দুই জন, চল্লিশোর্ধ্ব পাঁচ জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ছয় জন এবং ষাটোর্ধ্ব ১৯ জন রয়েছেন।
একই সময়ে বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মৃত ৩৪ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৯, চট্টগ্রামে ৬, রাজশাহীতে ৫, খুলনায় ৫, বরিশালে এক জন, সিলেটে তিন জন এবং রংপুরে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক জনের মৃত্যু হয়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে।
গোপালগঞ্জে ৭ জনের দেহে করোনার ভারতীয় ধরণ : গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী ইউনিয়নের তেলিভিটা গ্রামে ৭ জনের মধ্যে ডেলটা ভাইরাস ধরা পড়েছে। আইসিডিডিআবি'র সূত্র উল্লেখ করে জেলার সিভিল সার্জন অফিস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও রাশেদুল রহমান জানান, তেলিভিটা গ্রাম ও সাতপাড় ইউনিয়নের পশ্চিম অংশ নতুন করে লকডাউনের আওতায় আনা হবে। তবে সাতপাড়, বৌলতলী ও সাহাপুর ইউনিয়নের লকডাউন রোববার তুলে নেওয়া হবে।
শনিবার (৫ জুন) দুপুরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয় হয়।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন এই বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে জরুরি সভা করেছেন।
গত ১০ দিনে গোপালগঞ্জে আরো ১শ মানুষ করনা আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ৯শ ৪৩ জনে দাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৪০ জন। তবে এ সংখ্যা সরকারী। তবে বেসরকারী হিসাবে এসংখ্যা আরো বেশী বলে সাধারন মানুষ মনে করে।
অপর দিকে গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা: সুজাত আহমেদ বলেছেন, তারা জেলা প্রশাসনকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় লকডাউন জোরদার, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা জোরদার ও লাল নিশান দিয়ে এলাকা চিহ্নিত করতে অনুরোধ করবেন।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ওই ৭ জনকে হোম করেনটাইনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :