ঢাকা:উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো। অথচ উল্টো কমে যাচ্ছে লক্ষাধিক শিক্ষকের বেতন। জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে হযবরল পরিস্থিতি। প্রশিক্ষণ নেই এমন শিক্ষকদের চেয়ে বেতন কমেছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের। চাকরিতে জ্যেষ্ঠদের বেতন হয়েছে কনিষ্ঠদের চেয়ে কম। আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন চাকরিতে আগে যোগদানকারীরা।
অথচ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। তাই প্রশিক্ষণ নিলে তারা আলাদা গ্রেড পেতেন। কিন্তু ১৩তম গ্রেডে বেতন স্কেল উন্নীত করার পর সরকার প্রশিক্ষণ গ্রেড উঠিয়ে দেয়। বর্তমানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন সবারই ১৩তম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা। আর এই নতুন স্কেলে বেতন নির্ধারণ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
আকস্মিকভাবে বেতন কমে যাওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষাধিক শিক্ষক।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, 'বিষয়টি আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা বিষয়টি দেখছে।'
বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিন লাখ ৫২ হাজার সহকারী শিক্ষক। তাদের অর্ধেকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি এই শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৩তম গ্রেডের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে এই গ্রেডের সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, চিরায়ত নিয়মে বেতন নিম্ন ধাপে ফিক্সেশন করলে শিক্ষকদের বেতন কমে যাচ্ছিল। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের হস্তক্ষেপে ১৩তম গ্রেডের উচ্চ ধাপে বেতন ফিক্সেশন করায় সে জটিলতার সমাধান হয়। কিন্তু এবার নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন কমে যাওয়া নিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সফটওয়্যার 'আইবাস প্লাস প্লাসের' মাধ্যমে বেতন ফিক্সেশন হয়ে থাকে। কিন্তু এ সফটওয়্যারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের আলাদা কোনো গ্রেড নির্ধারণ করা নেই। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগবিধি অনুযায়ী, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের চেয়ে এক গ্রেড নিচে বেতন পেয়ে থাকেন। চাকরিকালে যেদিন তিনি প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হন, সেদিন থেকে উচ্চতর গ্রেডে তার বেতন নির্ধারণ করা হয়।
চাকরিবিধি (বিএসআর ৪২ (১),(২)) ধারা অনুযায়ী, বেতন উচ্চতর গ্রেডে হলেও ধাপে না মেলায় নিম্ন ধাপে বেতন নির্ধারণ করা হয়। ফলে শিক্ষকদের প্রকৃত মূল বেতন এক টাকাও না বেড়ে উল্টো কমে যায়। এই বেতন কমে যাওয়ার সঙ্গে ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। শিক্ষকরা জানান, বর্তমান ২০১৫ সালের পে-স্কেলের আগের পে-স্কেলগুলোতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হতো স্কেলভিত্তিক। তাই তখন মূল বেতন সাময়িকভাবে কমলেও ইনক্রিমেন্টের হার বেড়ে যাওয়ায় সাময়িক ক্ষতি এক সময় পুষিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমান পে-স্কেলে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হয় মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে। তাই গ্রেড যত ওপরেই হোক না কেন, মূল বেতনে যিনি একবার পেছনে পড়ে যান, তার আর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না। ফলে প্রশিক্ষণজনিত উচ্চতর গ্রেডের শিক্ষকরা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
শিক্ষকদের বক্তব্য :রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আরা বীথি বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে উল্টো তাদের বেতন কমে যাচ্ছে। আট মাস ধরে তারা সারাদেশের কমপক্ষে ৩০টি জেলা থেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে এই সমস্যার সমাধান চেয়ে সহস্রাধিক আবেদন পাঠিয়েছেন। শিক্ষকদের প্রতিনিধিরাও একাধিকবার বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রত্যেকবারই কর্মকর্তারা তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে সব সহকারী শিক্ষকের জন্য ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণের কাজ চলছে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণজনিত আর্থিক ক্ষতির সমাধান না করে ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হলে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে একই সঙ্গে যোগদানকারী শিক্ষকের চেয়ে সারাজীবন একটা ইনক্রিমেন্ট কম পেতে থাকবেন।
যশোর সদর উপজেলার নালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অলিউল ইসলাম বলেন, ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) প্রশিক্ষণ নিয়েও বেতন কমে যাওয়ার সমস্যার সমাধান করা না হলে তারা সারা চাকরিজীবনে এবং পেনশনে প্রায় পাঁচ শতাংশ হারে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হবেন।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তারকনাথ কংস বণিক প্রশ্ন তোলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা বাড়ানোর পুরস্কার যদি হয় বেতন কমে যাওয়া হয়, তাহলে এমন প্রশিক্ষণ আমরা নেব কেন? তিনি বলেন, ডিপিএড সমস্যার সমাধান না হলে আমরা এই সার্টিফিকেট প্রত্যাহারের আবেদন করতে বাধ্য হবো।
বগুড়া ধুনট উপজেলার ছোট এলাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আহসান কবির জিতু বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকরা বারবার মন্ত্রণালয়ে ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ এ পর্যন্ত নেয়নি বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ সমকালকে বলেন, লক্ষাধিক ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকদের উচ্চ ধাপে বেতন ফিক্সেশন এবং কমপক্ষে একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট দিলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
শিক্ষকরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে মহাপরিচালক বরাবর যেসব আবেদন পাঠিয়েছেন, সেগুলোতে বলা হয়েছে, সব যদি বাংলাদেশ সার্ভিস রুল (বিএসআর) ৪২(১)(২) ধারা অনুযায়ী চলে, তাহলে চাকরির ১০ বছরান্তে উন্নীত স্কেলে বেতন নির্ধারণেও সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমেই যেত। কিন্তু সেক্ষেত্রে চাকরিকালের ১০ বছর এবং প্রথম টাইম স্কেল পাওয়ার ছয় বছর পর কর্মচারীদের বেতন পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে ধাপে না মিললে নিম্ন ধাপ+পিপি না দিয়ে উচ্চ ধাপেই বেতন নির্ধারণ করা হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, কর্তৃপক্ষের আদেশে আদিষ্ট হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের বেতন কমবে কেন?
মূলত ২০১৫ সালে ঘোষিত অষ্টম পে-স্কেলের প্রশিক্ষণ গ্রেড কাছাকাছি নিম্ন ধাপে আপগ্রেড হওয়ার বিধিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম আর্থিক ক্ষতির কবলে পড়েছেন। প্রশিক্ষণ গ্রেড কাছাকাছি নিম্ন ধাপে নির্ধারিত হওয়ায় তারা একই স্মারকে যোগদানকারী ও জুনিয়র শিক্ষকদের চাইতে মূল বেতনে পিছিয়ে পড়ছেন। আর সবার বার্ষিক বর্ধিত বেতন পাঁচ শতাংশ হওয়ায় এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সারা কর্মজীবনেও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, পুরো বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তারা এ নিয়ে কাজ করছেন। অর্থ সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি- তিনিও সমাধানের কথা বলেছেন। তবে আদেশের কাগজ তো আমার কাছে আসতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাজেটের কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ ব্যস্ত। ৩০ জুনের পর আশা করি তারা এ নিয়ে কাজ করবে। শিক্ষকদের এটুকু বলতে পারি, সমস্যা সমাধানের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। সূত্র: সমকাল
সোনালীনিউজ/এইচএন
আপনার মতামত লিখুন :