ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মৃত আবেদ আলীর ছেলে আলতাফ হোসেন মারা গেছেন অনেক আগে। একই ইউনিয়নের নরেন্দ্রপুর গ্রামের আতর আলীও পরোপারে। ফকির আলীর ছেলে আনছার আলী সরকারী কর্মকর্তা। মৃত ছামেদ আলীর মেয়ে দুলি খাতুন ভিক্ষুক। অথচ তাদের নামে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে পাট বীজ ও সারের প্রণোদনার টাকা বিতরণ দেখানো হয়েছে। তারা মাষ্টর রোলে সাক্ষর করে টাকাও তুলেছেন। নরেন্দ্রপুর গ্রামের আনছার আলী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কোটচাঁদপুরে কর্মরত। পাট চাষিদের তালিকায় তার নাম দেখে তিনি বিস্মিত।
তিনি জানান, ৩৩ বছরের চাকরী জীবনে আমার কোন আবাদযোগ্য জমি ছিল না। তিনি জানান এই নামে নরেন্দ্রপুর গ্রামে আরেকজন আছেন। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, শুধু কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নেই নয়, সারা জেলায় পাট চাষে সার ও বীজ ভর্তুকীতে ঘাপলাবাজীর অভিযোগ উঠেছে। মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নে গ্রামের বাসিন্দা নয় এমন চাষীর নাম এবং চাষ হয়না এমন এলাকার কৃষকের নাম রয়েছে ভর্তুকির তালিকায় রয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় পাট চাষিদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রণোদনার বীজ-সার বিতরণে ব্যপক অনিয়ম হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা কে এম আব্দুল বাকী বলছেন, এই অনিয়মের ব্যাপারে তিনি তথ্য পেয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ের কমিটির সঙ্গে আলাপ করে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নে ২৩৫ জন পাট চাষির তালিকা দেওয়া হয়। এই তালিকায় মৃত ব্যক্তি ছাড়াও ভিক্ষুক ও ভুমিহীন মানুষের নাম রয়েছে। ইউপি সদস্যরা বলছেন তালিকা প্রণয়ন ও বিতরণের সময় তাদের বলা হয়নি। ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফ রিপন জানান, পাট বীজ ও সার বিতরণের খবর তিনি জানেন না। নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহম্মেদ রণি লস্কার জানান, অনেক সময় হুট করে তালিকা চাওয়া হলে দ্রুত তালিকা পাঠাতে যাচাই বাছাই করা সম্ভব হয় না।
তাছাড়া আমরা যে তালিকা জমা দিই সে মোতাবেক বীজ ও সার দেওয়া হয় না। ফলে অনেক কৃষক পায় আবার অনেকে পায় না। তিনি বলেন, আমি ব্যবসা বানিজ্য করি। পরিশ্রম করে খায়। কৃষকদের এই ২/৫ কেজি সার বা বীজ মেরে খাওয়া চেয়ারম্যান আমি নয়। আমি হারাম টাকা আয় করার বিপক্ষে বলেও তিনি জানান। এদিকে গেল পাট মৌসুমে মহেশপুর উপজেলায় পৌরসভা ও ১২ টি ইউনিয়নে উন্নতমানের পাট, পাট বীজ ও চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার আঠারো জন (২০১৮ জন) চাষীকে পাট অধিদপ্তর থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। চাষী প্রতি বরাদ্দ ছিল ৬ কেজি ইউরিয়া, টিএসপি ৩ কেজি এবং এমওপি ৩ কেজি হারে। কিন্তু তালিকার প্রায় অর্ধেক চাষীই পাট চাষে জড়িত না আর যারা জড়িত তাদের অর্ধেকই পায়নি কোন ভর্তুকির টাকা।
মহেশপুরে ভর্তুকির তালিকায় ৭৬ নম্বরে থাকা মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নের মান্দারবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আমিনুর রহমান জানান, আমার কোন পাট চাষ নেই। তবুও ভর্তুকির তালিকায় কিভাবে নাম আসলো তা তো বলতে পারবো না। আর তালিকায় এই গ্রামের যাদের নাম দেখলাম তারা এই গ্রামের বাসিন্দা নয়। বাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ভৈরবা গ্রামের চাষী রবিউল ইসলাম জানান, আমাদের গ্রামে কোন পাটের চাষ হয় না। আমরা সবাই ধান চাষ করি। নেপা ইউনিয়নের পাট চাষী শামীম হোসেন বলেন, আমার পাট চাষ রয়েছে। তবে কোন ভর্তুকি পায়নি। কখন এসব আসে তাও জানিনা।
মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিদুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতিই আমাদের এটা করিয়েছে। পাট কর্মকর্তার উপর দায় চাপিয়ে তিনি বলেন, পাট কর্মকর্তাকে বার বার বলা হলেও সে তালিকা ঠিক করেনি। এক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই। বাশবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক মন্ডল জানান, তালিকা প্রণয়নের সময় আমি ছিলাম না। এই ভুল তালিকা কিভাবে উপজেলায় গেল তাতো বলতে পারবোনা। বিষয়টি নিয়ে মহেশপুর উপজেলার দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা অপু কুমার শিকদার জানান, আমি একা এখানে কর্মরত। সব দিকে তদারকি করা আমার একার পক্ষে সম্ভব না। যে তালিকায় পেয়েছি সেভাবে চেয়ারম্যানদের বলেছি সার বিতরণ করতে। মহেশপুর ভর্তুকি বিতরণ সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্বতী শীল বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে হয়তো তালিকা প্রণয়নকারী ও বাছাই কমিটির কোন স্বজনপ্রীতি থাকতে পারে। বিষয়টি আমি যখন জানতে পেরেছি, অবশ্যই তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোনালীনিউজ/এআর/এসআই