চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় এক গৃহবধূকে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুনে ঝলসে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। উপজেলার গোয়ালপুরা গ্রামের সন্দ্বীপপাড়া এলাকায় শুক্রবার (২০ নভেম্বর) ভোরে এ ঘটনা ঘটে।
জনা যায়, রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে স্ত্রীর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেন স্বামী। স্ত্রী ঘর থেকে বের হতে চাইলে তার সুযোগও দেওয়া হয়নি। আগুন নিভে যাওয়ার পর ঝলসে যাওয়া শরীর থেকে টেনে-ঘষে খুলে নিলেন চামড়াও। এমনকি স্ত্রীর মরণচিৎকার শোনাতে শ্বশুরের মোবাইলে ফোন করে ভুক্তভুগির স্বামী বলেন, ‘তুর মেয়েকে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি, এসে নিয়ে যা।’ ফোনের একপ্রান্তে মেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছেন, অপরপ্রান্তে অসহায় পিতা-মাতা অপেক্ষায় ছিলেন ভোর হওয়ার। কারণ দুই বাড়ির মাঝে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী।
পরে শুক্রবার ভোরে মেয়ের স্বামীর বাড়িতে ছুটে গিয়ে মেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করা ইয়াসমিন আক্তারের প্রাণ বাঁচাতে তাকে নিয়ে ছোটেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। শুক্রবার রাতে চিকিৎসকরা জানান ইয়াসমিনের শরীরের ৪০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে, তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। পরিবারের সদস্যরা শনিবার ঢাকা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নির্যাতনের শিকার গৃহবধু ইয়াসমিন চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের নবগ্রাম এলাকার হারুনুর রশিদের মেয়ে। সাত বছর আগে তার বিয়ে হয় নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ইউনিয়নের সন্দ্বীপপাড়ার মৃত শফিকুল ইসলামের ছেলে মো. রাফেলের সাথে। রাফেল-ইয়াসমিনের সংসারে ৫ বছর বয়সের একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ রাফেলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে রাফেল ঘটনার নির্মমতার বর্ণনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, রাফেল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিনের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে যৌতুক নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাফেল ইয়াসমিনের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীর থেকে সে টেনে চামড়াও তুলে ফেলেছে। আবার আর্তচিৎকার শোনাতে ইয়াসমিনের পিতার মুঠোফোনে ফোন করেছে।
তিনি আরও বলেন, ইয়াসমিনের পিতা হারুনুর রশিদ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রাফেলকে আসামি করে রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা দায়ের করেছেন। শুক্রবার বিকেলে রাফেল আমাদের হাতে আটক হয়েছে। আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইয়াসমিনকে দেখে এসেছি। তার পরিবারকে আইনি সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসারও তদারকি করছি।
নির্যাতনের শিকার ইয়াসমিনের চাচা চন্দ্রঘোনা কদমতলী ইউপির সদস্য আবদুল মালেক জানান, রাফেল প্রায় সময় যৌতুকের জন্য আমার ভাতিজির ওপর নির্যাতন করতো। এ নিয়ে আমরা কয়েকবার মিটমাটও করিয়ে দিয়েছি। বৃহস্পতিবার রাতে রাফেল আমার ভাইকে ফোনে বলেছে, ‘তুর মেয়েকে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি, এসে নিয়ে যা।’ আমরা সকালে গিয়ে তাকে মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ৪০ ভাগ ড্যামেজ হয়ে গেছে। ইয়াসমিনকে ঢাকা পাঠাতে হবে। আমরা শনিবার (২১ নভেম্বর) সকালে নিয়ে যাবো।
যৌতুকের দাবিতে নিয়মিত বেপরোয়া নির্যাতনের এই ‘শক্তি’র উৎস কী— এমন প্রশ্নে এই ইউপি মেম্বার জানান, রাফেল স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। তিনি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন। তার রাজনৈতিক প্রভাব আছে। এর বলেই সে এসব অপকর্ম করে গেছে।
রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীম ফেসবুকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘তোর বিষ কমাচ্ছি— বলেই ইয়াসমিনের যোনি ও পায়ুপথসহ পুরো নিম্নাঙ্গে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন স্বামী। শরীরভর্তি দাউদাউ করে জ্বলন্ত লেলিহান শিখা। ৭ বছরের সংসার এবং ৪ বছর বয়সী সন্তানের দোহাই দিয়ে অসহায় ইয়াসমিন স্বামীর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও স্বামী রাফেলের তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। উপায়ান্তর না দেখে নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে ঘর থেকে বের হবার চেষ্টা করেন ইয়াসমিন। কিন্তু হায়, এখানেও স্বামীর বাঁধা। পুড়ে মরতে হবে, বের হওয়া চলবে না।’
আনোয়ার হোসেন শামীম লিখেছেন, ‘পুড়তে পুড়তে এক পর্যায়ে শরীরে লেপ্টে থাকা পেট্রল ফুরিয়ে গেলে ইয়াসমিনের শরীরের আগুনও নিভে যায়। কিন্তু নেভেনি রাফেলের নিষ্ঠুরতার আগুন। এবার নতুন খেলায় মাতে সে। স্ত্রীর পোড়া শরীর থেকে কাবাব করা মুরগির মতো করে চামড়া তুলে নিতে থাকেন দুই হাতের ঘষায়। একেক ঘর্ষণের সাথে খসে পড়তে থাকে পুড়ে যাওয়া চামড়া, সাথে ইয়াসমিনের মরণ আর্তচিৎকার। কিন্তু তাতেও রাফেলের নিষ্ঠুরতায় কোন হেরফের ঘটে না। উল্টো মেয়ের যন্ত্রণার খানিকটা ভাগ বাবা-মাকেও দিতে ফোন করেন ইয়াসমিনের বাসায়। এত গভীর রাতে জামাইর ফোন পেয়ে উৎকন্ঠিত শাশুড়ী ফোন তুলতেই তাকে সোজা জানিয়ে দেন, ‘তোর মেয়েকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি। এসে নিয়ে যা।’ রাফেলের পাশবিকতা-হিংস্রতার এখানেই শেষ নয়। পৈশাচিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ সৃষ্টি করে আর্তচিৎকার করতে থাকা স্ত্রীকে রেখেই পাশের কক্ষে গিয়ে দিব্যি ঘুমিয়েও পড়েন তিনি।’
সহকারী পুলিশ সুপার শামীম লিখেছেন, ‘পোড়া শরীর আপনাকে যে যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে, সেই যন্ত্রণার ভাগ হয়তো আমরা নিতে পারব না। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাকে পুড়িয়ে দেওয়া রাফেলকে যেভাবে আমরা পালিয়ে যাওয়ার আগেই গ্রেপ্তার করেছি, একইভাবে এই মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যা যা করা প্রয়োজন, তার সবকিছুই করা হবে। এখন দোয়া আর অপেক্ষা— শুধু আপনি সুস্থ হয়ে ফিরুন।’
সোনালীনিউজ/এমএইচ