গাজীপুর: গাজীপুরের কালীগঞ্জে স্মার্ট কার্ড বিতরণকালে স্থানীয়রা পৌরসভায় অবস্থানরত হকারদের দৌরাত্ম্যে বিব্রত হচ্ছেন স্মার্ট কার্ড নিতে আসা সাধারণ মানুষ। স্মার্ট কার্ড গ্রহণকারীরা মনে করছেন হকাররা বুঝি নির্বাচন অফিসের লোক।
কালীগঞ্জ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড ভাদার্ত্তী গ্রামের গৃহবধূ শিফা খন্দকার (২৬)। পেশায় তিনি একজন গৃহবধূ। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিস কর্তৃক পূর্ব ঘোষিত দিনে পৌরসভায় যান স্মার্ট কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) তুলতে। পৌরসভায় প্রবেশ পথে গিয়েই দেখেন অনেক মানুষের জটলা। গেইটের বাহিরে এবং ভেতরে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে চেয়ার পেতে স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে আছেন কিছু যুবক। কারো কারো মাথার উপর আবার বড় বড় ছাতা টাঙানো রয়েছে। রিকশা থেকে নামার পরই তারা ঘিরে ধরেন। বলে এখান থেকে এনআইডি বক্স নম্বর নিয়ে যান। এনআইডি কার্ড তাদের হাতে দিতেই মোবাইলে থেকে একটি স্লিপে বক্স নম্বর লিখে দিয়ে অন্য বুথে গিয়ে চোখের রেটিনা ও হাতের দশ আঙুলের ছাপ দিতে বলেন। এ সময় বক্স নম্বর লিখে দেওয়া বাবদ ১০ টাকা নেন। মনে করেছিলেন এটা বুঝি নির্বাচন পক্ষের লোক। পরে সেই বক্স নম্বর স্লিপ নিয়ে নির্দিষ্ট বুথে হাতের ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের রেটিনা দিয়ে অন্য বুথ থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করেন। স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করার পরই শুরু হয় পৌরসভার ভেতরে বিক্ষিপ্তভাবে লেমিনেটিং মেশিন ও কার্ড হোল্ডার, ক্লিপ ও ফিতা নিয়ে বসা হকারদের দৌরাত্ম্য।
গৃহবধূ শিফা খন্দকার বলেন, পূর্বের সকল নিয়মনীতি মেনে আমি যখন স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করলাম। তখন স্মার্ট কার্ড বিতরণ বুথের পাশে দাঁড়ানো একটি লোক আমার হাত থেকে স্মার্ট কার্ডটি টেনে নেয় এবং বলে ওখানে লেমিনেটিং হয়। পরে আমি তাকে দিয়ে দিলাম লেমিনেটিং করতে। পরে তিনি আমার স্মার্ট কার্ড কালার ফটোকপি শেষে লেমিনেটিং করে একটা কার্ড হোল্ডারে ক্লিপসহ লাগিয়ে আমার হাতে দেন এবং ৭০ টাকা দাবি করেন।
তিনি আরো বলেন, শুরুতে ওই লোকটি যখন আমার স্মার্ট কার্ডটি টেনে নেয় আমি মনে করেছিলাম তারা নির্বাচন অফিসের লোকজন। কিন্তু যখন টাকা দাবি করলো তখন বুঝতে পারলাম ওরা আসলে হকার। এ সময় আমার কাছে রিকশা ভাড়া ছাড়া আর কোন টাকা ছিল না। পরে আমি আমার স্বামীকে ফোন দিয়ে এনে সেই টাকা দিয়ে চলে আসি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই এলাকার ত্রিশোর্ধ আরেক গৃহবধূ জানান, তিনি পৌরসভার প্রবেশ দ্বারে হকারদের কাছ থেকে ১০ টাকায় বক্স নম্বর স্লিপ নিয়ে নির্দিষ্ট বুথে হাতের ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের রেটিনা দিয়ে অন্য বুথ থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করেন। স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করার পর বুথের পাশে দাঁড়ানো এক লোক তার স্মার্ট কার্ড টেনে নেয় লেমিনেটিং করার জন্য। এ সময় তার সাথে স্বামী থাকায় তিনি বিষয়টি নিয়ে ওই হকারকে ধমক দিলে হকার স্যরি বলে কেটে পড়েন।
পৌর এলাকার স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করতে আসা সুজন মিয়া নামের এক যুবক জানান, তার পুরনো এনআইডি কার্ডটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করার পর বুথে গিয়ে বিষয়টি বললে ৩৭০ টাকা দিতে বলে। পরে তিনি ওই পরিমাণ টাকা দিয়ে স্মার্ট গ্রহণ করেন।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার কয়েকজন কর্মচারী জানান, এমনিতেই ছোট পৌর ভবন তারপর স্মার্ট কার্ড নিতে আসা লোকজনে পুরোপুরি ঠাসা থাকে। তারমধ্যে অসংখ্য হকারের আনাগোনা। কেউ লেমিনেটিং মেশিন নিয়ে বসা, কেউ স্ক্যানার ও ফটোকটি মেশিন নিয়ে বসা, কেউ আবার কার্ড হোল্ডার, ক্লিপ-ফিতা নিয়ে বসা। আমরা তাদের প্রতিদিনই পৌরসভার বাইরে যেতে বলি। কিন্তু তরা আমাদের কথা আমলে নেয়না।
স্মার্ট প্রদানকারী দলের টেকনিক্যাল সাপোর্টার ও টিম লিডার মো. শিমুল মিয়া বলেন, স্মার্ট কার্ড বিতরণকে কেন্দ্র করে কালীগঞ্জ পৌরসভার ভেতরে অসংখ্য হকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা তাদের কিছু করতে পারিনা। কারণ আমরা গাজীপুর থেকে কার্ড বিতরণ করতে পৌরসভায় এসেছি। স্থানীয়রা সহযোগীতা না করলে আমাদের কিছু করার নেই। তারপরও তাদের প্রতিদিন একাধিকবার পৌরসভার বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেন না। স্মার্ট কার্ড গ্রহণকারীরা অনেক সময় ওই হকারদের নির্বাচন অফিসের লোকবল মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
হারিয়ে যাওয়া এনআইডি কার্ডে ৩৭০ টাকা গ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা সরকারি ফি। সরকারের কোষাগারে গ্রহণকৃত টাকা জমা হবে। এখন যারা স্মার্ট কার্ড নিতে আসতেছে আমরা কাউকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিনা। এজন্য গ্রহণকৃত টাকা এনআইডি’র সাথে স্টেপল করে রেখে দিচ্ছি। পরে চালান কপির মাধ্যমে সেই টাকা সোনালী ব্যাংকে নির্বাচন কমিশনের হিসাব নম্বরে জমা হবে।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারিজা নূর বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। তবে এমনটা হওয়ার কথা নয় এবং হওয়া উচিতও নয়। যেহেতু আমি জানলাম পৌর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র এস.এম রবীন হোসেন বলেন, পৌরসভার ভেতরে হকারদের আনাগোনায় স্মার্ট কার্ড গ্রহণকারীরা মনে করে ওরা নির্বাচন অফিসের লোকজন। এতে স্মার্ট কার্ড গ্রহণকারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। আমি কয়েকবার লোকজন দিয়ে হকারদের বাইরে বের করে দিয়েছি এবং তাদের ডেকে পৌরসভার ভবনের বাইরে বসতে বলেছি। যদি বাইরে তাদের কাছে গিয়ে কাজ করায় তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা না।
উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী গত ১৭ মে থেকে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ৩৬ হাজার ৬৩৩ জনের মাঝে স্মাট কার্ড বিতরণের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিদিনি সকাল ৯টা থেকে ৪ পর্যন্ত কয়েকটি বুথে এ স্মাট কার্ড বিতরণ করা হয়। চলবে আগামী ৬ জুন পর্যন্ত।
সোনালীনিউজ/এন