গাজীপুর : টঙ্গীর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের অত্যাচারে ব্যবসা গুটিয়ে স্থায়ীভাবে দেশতাগের ঘোষণা দিলেন হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম তমিজি হক।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) ভোরে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে তিনি যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আজ দুপুরে আমি একটি সৌদিয়া ফ্লাইটে জেদ্দার উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করব।’
তবে তিনি রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) দেশ ত্যাগ করেছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও তার চাচাকে জড়িয়ে আদম তমিজির একাধিক ফেসবুক স্ট্যাটাসে টঙ্গী-গাজীপুরে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ, লুটপাট ও কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির অভিযোগ করেন দেশের পৌনে এক শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগোষ্ঠী হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম তমিজি হক। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক।
[207162]
গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও তার চাচা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান মতির লুটপাটের কারণে তাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি মুখ থুবড়ে পড়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, তারা (প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা) আমাদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট করেছে।
তিন দিন ধরে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাইভে এসে এবং একাধিক লিখিত পোস্টে এসব অভিযোগ করেন দ্বৈত নাগরিক আদম তমিজি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত শনিবার টঙ্গীতে তার হক বিস্কিট ফ্যাক্টরিতে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। কিন্তু ঘোষণা দিয়েও তিনি পরে আর কারখানায় যাননি।
গত শনিবার মধ্যরাতে আদম তমিজি তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘আর বাকি কিছু নেই, শ্রমিক, ব্যাংকস ও সরবরাহকারীদের টাকা জাহিদ আহসান রাসেলের কাছে আছে। ওনার থেকে বুঝে নিবেন। আমি সৌদি যাচ্ছি। তার পর আমার জন্মভূমি ইউকে চলে যাচ্ছি। বাদশাহী দীর্ঘজীবী হোক।’
আদম তমিজি হক ঢাকা মহানগর উত্তর তাঁতী লীগের প্রধান উপদেষ্টা এবং মানবিক বাংলাদেশ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তার প্রতিষ্ঠিত ওই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
‘আওয়ামী লীগের মতো নিকৃষ্ট দলকে ভোট দিবেন না’- আদম তমিজি : এ দিকে লুটপাটের বিচার না পেয়ে ক্ষোভে নিজের বাংলাদেশী পাসপোর্ট প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেললেন আদম তমিজি হক।
গত শনিবার সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে এসে পাসপোর্ট পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি আদম তমিজি হক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমার এক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি মাইরা, আমাকে দেশ থেকে ছাইড়া যাইতে বাধ্য করতে মিথ্যা মামলা দিয়া আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। যার জন্য আমি আমার বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বর্জন করলাম। আমি আর এই দেশের নাগরিক থাকতে চাচ্ছি না। এই দেশের নাগরিক হওয়ার আমার যোগ্যতা নাই। আমি চুরি বাটপারি কিছুই করতে পারি না।’
[207094]
তিনি বলেন, ‘আমার ফ্যামিলির যদি কিচ্ছু হয়, আপনারা দয়া করে খুঁজবেন কারা করছে। আর আমি এই কথাটা বলে রাখব, আওয়ামী লীগের মতো নিকৃষ্ট দলকে আপনারা ভোট দিবেন না। অন্য যার জন্য দিবেন। বাই, বাই, বাংলাদেশ; আপনারা অনেক সুখে থাকবেন আওয়ামী লীগকে নিয়ে। এই দেশের জন্য আমি প্রযোজ্য নাগরিক না, আমি ব্রিটিশ, আই বর্ন ইন ইংল্যান্ড, আই রিটার্ন টু মাই কান্ট্রি।’
প্রতিমন্ত্রীকে চোর বললেন তমিজি : গত শুক্রবার রাতে বিদেশে অবস্থানকালে আদম তমিজি হক ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, ‘শুভ বিকেল, আমার কারখানা থেকে বেআইনিভাবে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি আমার বাবার বন্ধু। প্রতিমন্ত্রী রাসেল, তার চাচা মতিউর রহমান মতি ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরু আমার প্রতিষ্ঠান থেকে বেআইনিভাবে টাকা পয়সা নিতেন। তারা এ পর্যন্ত আমার এক হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন।’
এ সময় তিনি প্রতিমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুই একটা চোর, বাটপার, তুই আমাকে চিনিস। আমি টঙ্গীতে আসতেছি। সাহস থাকলে ঠেকা।’
অন্য এক স্ট্যাটাসে আদম তমিজি লিখেছেন, ‘প্রিয় নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী), আমি ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী দুবাই থেকে ঢাকার পথে। বাকি পারিবারিক সদস্যরা আজকে রাতে রওনা করবে এবং সকালে পৌঁছাবে। এমপি রাসেল ও তার চাচার ভয়ানক থাবা থেকে আমরা আমাদের রিজিক বাঁচানোর লক্ষ্যে আসতেছি।’
বুধবার যা ঘটেছিল হক ফ্যাক্টরিতে : গত বুধবার টঙ্গীতে রাজউকের শিল্প জোনে অবস্থিত হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (এ টি হক বিস্কিট ফ্যাক্টরি) কারখানার ভেতরে কারখানার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা-সিওও মুশফিকুর রহমান রুমেলকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের দায়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে অপর কর্মকর্তা (মানবসম্পদ) ইশান খানের বিরুদ্ধে। ঘটনা মীমাংসার জন্য ওই দিন রাতে দলীয় লোকজন নিয়ে কারখানার ভেতর যান প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি। পরে পুলিশ গিয়ে মুশফিকুর রহমানকে উদ্ধার করে।
এ ব্যাপারে জিএমপি টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হক গ্রুপের কারখানার দুই ম্যানেজারের মধ্যে মারামারি হচ্ছে এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আহতাবস্থায় মুশফিকুর রহমানকে উদ্ধার করে তার স্ত্রীর জিম্মায় দেয়া হয়। বিষয়টি কারখানার অভ্যন্তরীণ হওয়ায় তারা মালিকের সাথে আলোচনা করে অভিযোগ দেবেন বলে জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ থানায় লিখিত কিংবা মৌখিক অভিযোগ দেয়নি।
তমিজি হকের ফেসবুক লাইভে ব্যাপক তোলপাড় : এ দিকে আদম তমিজি হকের ফেসবুক লাইভ কেন্দ্র করে টঙ্গী তথা গাজীপুরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রতিমন্ত্রী ও তার চাচার বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় তাদের সমর্থক দলীয় নেতাকর্মীরা টঙ্গীতে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল, ঝাড়ু মিছিল, মশাল মিছিল করছেন। কারখানাটির সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
প্রতিমন্ত্রীর চাচার বিরুদ্ধে কারখানা দখল চেষ্টার অভিযোগ : গত বৃহস্পতিবার তমিজি হক অভিযোগ করে বলেন, হক গ্রুপের কারখানা দখলের জন্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি এবং হক গ্রুপের বরখাস্তকৃত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুমেল মিলে ষড়যন্ত্র করছেন। গত শুক্রবার আদম তমিজি নিজের ভেরিফাইভ ফেসবুক আইডিতে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় একাধিক পোস্ট করেন।
এক পোস্টে তিনি বলেন, “২০১৬ সালে আমি ‘বিশ্বস্ত কর্মচারীদের’ হাতে একটি সফল কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিলাম এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যারা আমাদেরকে কয়েক দশক ধরে চেনেন তারাও এটির ওপর নজর রাখতে সম্মত হন। এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আমি শ্রমিকদের বেতন দিতে পারি না, আমি সরবরাহকারীদের পাওনা দিতে পারি না, আমি ব্যাংককে টাকা দিতে পারি না। কারণ তারা (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা) আমাদের কাছ থেকে ১০০০ কোটি টাকা লুট করেছে এবং আমরা শেষ হয়ে গেছি।”
তিনি এ সময় প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলকে ‘চোর’ এবং তার চাচা মতিউর রহমান মতিকে ‘গাজীপুরের গডফাদার, টোকাই অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান।
[206657]
ভিক্ষুক হওয়ার আগেই আমার টাকা ফেরত দিন : আদম তমিজি বলেন, ‘অনুগ্রহ করে লুট করা ১০০০ কোটি টাকা ফেরত দিন, যাতে আমি শান্তিতে এই দেশ ছেড়ে যেতে পারি।
আমি আর এ দেশে থাকতে চাই না। আমরা সবাই ভিক্ষুক হওয়ার আগেই আমাদের লুট হওয়া অর্থ অনুগ্রহ করে ফেরত দিন, যাতে আমি আমার পাওনাদারদের অর্থ প্রদান করে তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারি। আমার এত শ্রমের পরে এই ছিল আমার পুরস্কার? আমি যে অবদান রেখেছি তা ছিনিয়ে নেয়া?
অপর এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ‘যারা পারেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ, সব কিছু ছেড়ে চলে যান। এ দেশ মেরামতের বাইরে। একই পুরনো বদমাশ প্রতিবার।’
এ দিকে এ ব্যাপারে বক্তব্য নেয়ার জন্য আদম তমিজি হকের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরুল ইসলাম নূরু বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আদম তমিজি হকের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘গত বুধবার রাত ১০টায় হক ফ্যাক্টরির ভেতরে ওই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমানকে মারধর করা হয়। মারধরের সময় তার হাতের একটি আঙুল কেটে যায়। যেহেতু আমি রাজনীতি করি, তাই খবর পেয়ে সেখানে যাই। পুলিশও সেখানে যায়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে গুরুতর আহতাবস্থায় মুশফিকুর রহমানকে উদ্ধার করে তার স্ত্রী মলি রহমানের হেফাজতে দেয়া হয়। কিন্তু ভয়ে তারা কোনো অভিযোগ করেনি।’ এ দিকে ফোন রিসিভ না করায় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এমটিআই