যেভাবে পাগলা মসজিদের দানের টাকা খরচ হয়

  • কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ১২:১০ পিএম

কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যের স্মারক পাগলা মসজিদ। দেশ-বিদেশে সুনাম রয়েছে এই মসজিদের। প্রায় তিন মাস পরপর এই মসজিদের দান করা টাকার হিসাব নিয়ে আলোচনা হয় দেশব্যাপী। দৈনিক প্রায় লাখ টাকা জমা পড়ে পাগলা মসজিদের দানবাক্সে।

দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রা এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। মুসলিম-অমুসলিম সবাই এ মসজিদে দুই হাত খুলে দান করেন। মানুষের বিশ্বাস, একনিষ্ঠ মনে এখানে দান করলে রোগ-শোক ইত্যাদি বালা-মুসিবত দূর হয়।

পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত। মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু দৃষ্টিনন্দন মিনার। লোকমুখে শোনা যায়, একদা প্রমত্তা নরসুন্দা নদীর পানিতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের আবির্ভাব হয়। তার কল্যাণেই নদীর মধ্যে চর জেগে ওঠে। নদীর তীরবর্তী রাখুয়াইল গ্রামের এক গৃহস্থের গাভি নিয়মিত নদী সাঁতরে ওই দরবেশের ভাণ্ডে ওলানের দুধ দিয়ে আসত।

এতেই গাভির দরিদ্র মালিক ও স্থানীয় লোকজনের অনেক বৈষয়িক উন্নতি হয়। এমন আরও অসংখ্য কেরামতিতে বিমুগ্ধ মানুষজন ওই দরবেশের খেদমতে হুজরাখানা তৈরি করে। দরবেশের মৃত্যুর পর তার হুজরাখানার পাশেই পাগলা সাধকের স্মৃতিতে পাগলা মসজিদ নির্মিত হয়। তবে এই জনশ্রুতির ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

আরেক জনশ্রুতি হলো, হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির এক নিঃসন্তান মহিলাকে জনগণ পাগলা বিবি বলে ডাকত। এ মহিলা নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে তা পাগলা বিবির নামে পরিচিতি পায়।

হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির ১০ শতাংশ ওয়াকফ সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা পাগলা মসজিদের বর্তমান জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। মসজিদের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে এতিমখানা ও মাদ্রাসা। এখানে ছেলেমেয়েদের থাকা-খাওয়া, পোশাকসহ লেখাপড়ার খরচ বহন করা হয়।

[221761]

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে নিযুক্ত হোন। তার তদারকিতে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে মসজিদের অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশ করা হয়। পাগলা মসজিদের বর্তমান কমিটিতে ৩১ সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা আছেন।

পাগলা মসজিদের অর্থায়নে এলাকার অন্যান্য প্রাচীন মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়। এলাকার দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ ও অসচ্ছল পরিবারের জন্য পাগলা মসজিদ থেকে অনুদান দেওয়া হয়। লেখাপড়া, চিকিৎসা, অভাবী নারীর বিয়ের সময় সাহায্য করা এই মসজিদের গণমুখী কার্যক্রমের অংশ।

ওয়াকফ এস্টেটের অডিটর দ্বারা পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়। অডিটের পর প্রতি অর্থবছরে আয়ের ওপর ৫ শতাংশ ওয়াকফ প্রশাসন চাঁদা নিয়ে যায়। ব্যাংকে রাখা দানের টাকা থেকে মসজিদ-মাদ্রাসার ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা, আনসারের বেতন বাবদ প্রায় ২ লাখ, বিদ্যুৎ বিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মসজিদ-মাদ্রাসার গ্যাস বিল বাবদ প্রায় ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসায় অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা শুধু শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দান থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের।

দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশের একটি বিশেষ অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়।

২০২১ অর্থবছরে ১২৪ জন দুরারোগ্য ব্যাধিতে (ক্যানসার, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট স্ট্রোক, কিডনি রোগ, প্যারালাইসিস ইত্যাদি) আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায়কে চিকিৎসা এবং দরিদ্র ও দুস্থ মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ বাবদ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পাগলা মসজিদের ফান্ড থেকে অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনাকালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

গত শনিবার (২০ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৭টায় মসজিদের ৯টি লোহার দানবাক্স খুলে পাওয়া যায় ২৭ বস্তা টাকা। সেগুলো মসজিদের দোতলায় এনে গণনার কাজ শুরু করা হয়। শেষ হয় রাত ২টায়। গণনা শেষে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা পাওয়া যায়। ২২০ জনের একটি দল দীর্ঘ সাড়ে ১৮ ঘণ্টায় টাকা গণনা কাজ শেষ করেন।

এর আগে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর খোলা হয়েছিল পাগলা মসজিদের ৯টি দানবাক্স। তখন ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। ২০২৩ সালে চারবার খোলা হয়েছিল পাগলা মসজিদের দানবাক্স। চারবারে ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৮১ টাকা পাওয়া যায়।

এমটিআই