সব বাধা জয় করে সাফল্যের শিখরে চার জয়িতা

  • তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২৪, ০৪:১১ পিএম

তাড়াশ: বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে চারজন জয়িতা ছিনিয়ে এনেছেন তাদের সাফল্য। স্ব স্ব ক্ষেত্রে রেখেছেন দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। এদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প বিভীষিকাময়। অনেক অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আজ তারা সাফল্যের মণিকোঠায়। এই চারজন জয়িতার গল্প নিয়েই অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের এ বছর চার ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করেছেন তাড়াশ উপজেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর। আর সেই জয়ী হওয়া নারীদের গল্পগুলো যেন অন্যদের প্রেরণা হয়ে দেখা দেয় বলে জানান, তাড়াশ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. খাদিজা নাসরিন।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী 

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন মোছা. জহুরা জান্নাত (লাকী)। তিনি উপজেলা দেশিগ্রাম ইউনিয়নের ক্ষিরসিন গ্রামের ইউনুস আলীর স্ত্রী। জহুরা জান্নাত (লাকী) গুড়পিপুল ও শিলংদহ গ্রামের কিছু অবহেলিত, দরিদ্র, নিপীড়িত, দুঃস্থ মহিলাদের একত্রিত করে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষিরসিন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি গঠন করেন। বর্তমানে তিনি সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে সদস্যদেরকে সঞ্চয়ের প্রতি উৎসাহিত ও মহিলাদের স্বাবলম্বী করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনার জন্য গ্রামে বাল্য বিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি  বিষয়ে মহিলাদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করছেন। নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ, গবাদি পশুপালন প্রশিক্ষণ, সবজির বাগান প্রশিক্ষণ, ফ্যাশন ডিজাইন প্রশিক্ষণ করানোর ব্যবস্থা করেন। নারীদের স্বাস্থ্য সেবায় তিনি গ্রামের গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা , শিশুদের টিকা প্রদান, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে সচেতন করে থাকেন। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় গ্রামের অনেক পরিবারকে স্যানেটারী ল্যাট্রিন প্রদান করেছেন। এভাবে সমাজ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন জহুরা জান্নাত (লাকী)।

সফল জননী নারী

সফল জননী বেগম রোকেয়া হোসেন। উপজেলার পৌর এলাকার বাসিন্দা তিনি। রোকেয়া হোসেনের স্বামী মোক্তার হোসেন ছিলেন বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। স্বামী ব্রেন টিউমারে আক্তান্ত হওয়ায় সুচিকিৎসার জন্য তিনি দেশের বাইরে নিয়েও স্বামীকে চিকিৎসা করান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে সংসারে আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় সন্তানদের লেখাপড়া এবং সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। স্বামী যেটুকু জমি ও বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন শুরু ও বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ শুরু করেন। পাশাপাশি সেলাই মেশিনে প্রতিবেশিদের কাপড় সেলাই করতেন। বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর পরিশ্রম করে তিনি তিন সন্তানকে পড়াশোনা চালিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। বর্তমানে বড় মেয়ে ও ছোট ছেলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আরেক ছেলে ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজার পদে চাকুরী করেন। এভাবেই তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার সন্তানদের। বর্তমানে পরিবারটি একটি  সচ্ছল ও সুখী পরিবার এবং তিনি একজন সফল জননী।

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জকারী নারী

সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার ঘরগ্রামের মৃত আব্দুল আজিজের মেয়ে মোছা. সেলিনা খাতুন। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে তার গল্পটা একটু ভিন্ন। হতদরিদ্র্র পরিবারের সন্তান তিনি। বসবাস করার মত জায়গাটুকুও ছিলো না।এ পরিস্থিতিতে বসে থাকেননি তিনি। শুরু করেন টিউশনি। এরপর নিজের কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধি খাটিয়ে টিউশনির মাত্র ৮ হাজার টাকা দিয়ে দেন ছাগলের খামার। বর্তমানে তিনি ওই খামার থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেছেন। লেখাপড়া ও সংসার খরচের পর বাকী টাকা দিয়ে শুরু করেন জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ। এভাবে শুরু হয় তার দিন বদলের চেষ্টা। বিভিন্ন বাধা প্রতিকুলতা কাটিয়ে এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি সরকারী চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন মোছা. সেলিনা খাতুন। বর্তমানে তিনি জলিল নগর কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেতে সাফল্য অর্জকারী নারী

শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম মাহফুজা খাতুন। তিনি উপজেলার মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের নাদোসৈয়দপুর নদীপাড়া গ্রামের মৃত মো. ওয়াহিদ মুরাদের স্ত্রী।এস.এস.সি পাশ করার পরপরই পিতা-মাতার ইচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হয়ে স্বামীর সংসারে সংসার শুরু করেন তিনি। দাম্পতি জীবনে একটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তানের মা তিনি। স্বামীর নিম্ন আয়ের জন্য পরিবারের সকলের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় তিনি মাত্র ৫৭০/- টাকা মাসিক বেতনে গ্রামে একটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকতা শুরু করেন। স্বামীর সংসারে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা অবস্থায় তাঁর প্রথম কন্যা সন্তান পানিতে ডুবে মারা যায়। তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও পরে তাঁর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নিম্ন আয়ের উপার্জিত অর্থ দিয়ে দুটি সন্তাকে লেখাপাড়া চালিয়ে যায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন টিউশনি। সেইসাথে স্বামীর সামন্য জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাহফুজা খাতুন ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষত হওয়ার। তাই সংসারের সকল কাজ সামলে শত ঝামেলার মধ্যেও তিনি এইচএসসি এবং বিএ পাশ করেন। বর্তমানে তিনি নাদোসৈয়দপুর বাজারপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

এমএস