নারায়ণগঞ্জ: এলাকায় অবস্থিত গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার কারখানায় রোববার (২৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন লাগে। প্রায় ২২ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন নেভানোর কাজ তখনো চলছিল। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করেছে। এ পর্যন্ত ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও ফায়ার সার্ভিসের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজের নাম-ঠিকানা দিয়েছে স্বজনরা। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম এক ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান।
এদিকে আগুন লাগার আগে কারখানায় চলছিল লুটপাট। চনপাড়া বস্তি ও বরাবো খাদুন এলাকার দেশীয় অস্ত্রধারী দুটি গ্রুপ লুটপাটকে কেন্দ্র করে কারখানার ভেতরে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বের জেরে একটি পক্ষ ছয়তলা ভবনের নিচতলায় মেইন গেটের শাটারে তালা লাগিয়ে দেয়। এ কারণে ভেতরে আটকে পড়া লোকজন কেউ বের হতে পারেনি। অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের স্বজনরা গত রোববার বিকেলে ও রাতে গাজী টায়ার কারখানায় গিয়েছিল। এরপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংকের কারখানা রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে গাজী টায়ার কারখানা ও গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানায় প্রবেশ করে ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট করে। একপর্যায়ে ওই দুটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রূপগঞ্জের নব কিশোলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামি গোলাম দস্তগীর গাজীকে গত রবিবার ঢাকার শান্তিনগর থেকে গ্রেপ্তার এবং আদালতে সোপর্দ করার পর আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এ খবরের পরই গত রবিবার বিকেলের দিকে তিন-চার শতাধিক লোক আবারও লাঠিসোঁটা নিয়ে রূপসী গাজী টায়ার কারখানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। চনপাড়া থেকে একটি গ্রুপ লুটপাটের উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গাজী টায়ার কারখানায় প্রবেশ করে লুটপাট চালায়। পরে অপর একটি গ্রুপ বরাবো ও খাদুন এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে লুটপাট চালাতে যায়। এ সময় রূপগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা থেকে সাধারণ মানুষও মালামাল লুট করতে কারখানায় প্রবেশ করে। লুটপাট নিয়ে একপর্যায়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পুরো টায়ার কারখানায় ব্যাপক লুটপাট চলে।
[230612]
রাত ১০টার দিকে একটি পক্ষ গাজী টায়ারের ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুন দিয়ে নিচে গেটে তালাবদ্ধ করে রেখে চলে যায়। একপর্যায়ে আগুনের লেলিহান শিখা ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচু হয়। ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন। এ কারণে ছয়তলা ভবনে থাকা মানুষজন বের হতে পারেনি। ছয়তলা ভবনটিতে অন্তত ২০০ মানুষ আটকা পড়েছিল। ওই ভবনে কেমিক্যাল এবং টায়ার তৈরির কাঁচামালসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ছিল। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট কাজ শুরু কর। দীর্ঘ ২২ ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা। বেশির ভাগ নিখোঁজের বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাবো, চনপাড়া, মুড়াপাড়াসহ আশপাশের এলাকায়। আগুন দেখতে উৎসুক জনতাকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ও কারখানার বাইরে ভিড় করতে দেখা যায়। এতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দীর্ঘ ১০ কিলোটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসা-যাওয়া করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এদিকে পানি স্বল্পতার কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়।
গেট তালাবন্ধ না করলে বেরিয়ে আসতে পারত আটকে থাকা ব্যক্তিরা : ভবনটির নিচতলার শাটারের গেটটি তালাবন্ধ না করলে আগুন লাগার পরও আটকে থাকারা বেরিয়ে আসতে পারত বলে জানান মিলের শ্রমিকরা। কিন্তু একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ গেটের শাটারে তালা দিয়ে কেমিক্যালে আগুন ধরিয়ে দেয়। আটকে পড়া ব্যক্তিরা গেটে তালা দিয়ে দেওয়া পরের তলাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নেন। আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে কারখানার ভেতরে স্বজনরা : স্বজনদের খোঁজে গাজী টায়ার কারখানার ভেতরে ও বাইরে স্বজনদের ভিড় জমাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ইদ্রিস খলিফা গাজী টায়ারে শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিনই গাজী টায়ারে হামলা হয়ে লুটপাট হলেও মালিকপক্ষ বলেছিল কারখানা আবারও চালু করা হবে। সে আশায় রবিবার বিকেলে লুটপাটের খবর পেয়ে কারখানায় আসেন দেখতে। এরপর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ইদ্রিস খলিফা। স্ত্রী ঝর্ণা বেগম তার স্বামীর খোঁজ না পেয়ে পাগলপ্রায়।
বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খান, শাহিনসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছে। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হয়নি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে তারা ভবনে আটকা পড়েছে। আমাদের বাঁচান। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।’
মুড়াপাড়া এলাকার আব্দুল হাই বলেন, রাত ১১টার দিকে আমার পোলা শাকিল (১৪) বন্ধুগো লগে আইছিল মিলের লুটপাট দেহার লাইগা। এরপর থেইকা হের আর কোনো খোঁজ পাইতাছি না। মোবাইলডাও বন্ধ পাইতাছি।’ চাচা মিলন গাজী বলেন, ‘আমার ভাতিজা স্বাধীনের বাবা ছোটবেলাতেই মারা গেছে। সে এতিম ছিল। আমরাই তারে কোনো রকম দেখে রাখতাম। গতকাল রাত থেকে স্বাধীনের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’
ভয়াবহ এই আগুনে কারখানার আশপাশের মার্কেট, হাটবাজার, শিল্প কলকারখানা এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিএনপি নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
ভবনে আটকাপড়া ব্যক্তিরা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন রাত ১২টা পর্যন্ত : গাজী টায়ারের ছয়তলা ভবনের ভেতরে আটকাপড়া ব্যক্তিরা মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তাদের বাঁচাতে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন কারখানার পাশে থাকা স্থানীয়রা। কারখানাটির পাশে বসবাসকারী রূপসী এলাকার রাজু আহমেদ বলেন, ‘আগুন লাগার পর রাত ১২টা পর্যন্ত মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে আটকাপড়া লোকজন তাদের বাঁচানোর জন্য সাহায্য চেয়েছিল। আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারিনি। ১২টার পর তাদের আর সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি আর কোনো মোবাইলের টর্চ জ্বলতে দেখা যায়নি।’
কেমিক্যালে পরিপূর্ণ ছিল ভবনটি : বিভিন্ন ধরনের সিন্থেটিক রাবার, প্রাকৃতিক রাবার, ফ্যাব্রিক, তার, কার্বনসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও টায়ারে পরিবপূর্ণ ছিল পুরো ভবন। ভবনটিতে টায়ার তৈরি ও রাসায়নিক মজুদ করে রাখা ছিল। এ কারণে আগুন লাগার পর কিছুক্ষণ পরপরই কেমিকেল বিস্ফোরণের শব্দ পাচ্ছিল এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষক) লে. কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই। আগুন এখন আর অন্যদিকে ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগুন পুরোপুরি নেভানোর পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে বলা যাবে ভবনের ভেতরে কেউ আছে কি না। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণের পর জানা যাবে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে সাংগঠনিকভাবে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজী সাহেব অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুটি রোজগারের জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংস করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কোথায় যাবেন।’
কারখানার অ্যাডমিন ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকান্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই টায়ার কারখানায় সব দামি দামি মেশিনারিজ ছিল।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘কেউ কোনো ধরনের অরাজকতা, লুটপাট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। প্রচলিত আইনে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘একটি পক্ষ আগুন লাগিয়েছে এবং আরেকটি পক্ষ লুটপাট চালিয়েছে বলে আমি শুনেছি।’
এসআই