পাবনা: ‘ছেলেটার সাথে হাসপাতালের বিছানায় বসে গল্প করেছি। খাবার খেয়েছি। মনে হয় নাই সে বড় কোনো অসুস্থ্য। হঠাৎ করেই তার মুখ দিয়ে লালা বের হওয়া শুরু হয়। ডাক্তার ডেকেও চিকিৎসা মেলেনি। এক পর্যায়ে ভোরে আযানের সময় ছেলেটা আমার বুকের মধ্যে জড়িয়ে থাকাবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।’
এভাবেই একমাত্র ছেলে এস এম সাফিউর রহমানের (১৯) মৃত্যুর বর্ণনা দেন তার পিতা এস এম রেজাউল করিম পাশা। তার বাড়ি পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের ছোট শালিকা মহল্লায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তার ছেলে। হঠাৎ করেই অসুস্থ্য হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা না দিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ বাবা রেজাউল করিম পাশার।
এস এম সাফিউর রহমান চাঁদপুর ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (আইএমটি)'র মেরিন টেকনোলজি বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। কিছুদিন পরই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হবার পর তার দেশের বাইরে যাবার কথা ছিল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা পাগল প্রায়। মা কামরুন্নাহার বাকরুদ্ধ। ছেলে ফিরে আসবে এমন অপেক্ষায় এখনও পথ চেয়ে আছেন তিনি।
[230707]
আলাপকালে রেজাউল করিম পাশা জানান, ১৪ জুলাই চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কোটা বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন তার ছেলে সাফি। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে একইদিন সন্ধ্যায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা চাঁদপুর ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (আইএমটি)’র শিক্ষার্থী রাসেলসহ অন্যান্যদেরকে তুলে আনতে ক্যাম্পাসে যায়। এ সময় শেষ বর্ষের ছাত্র সাফিউর রহমানসহ তার সহপাঠীরা তাদের বাধা দেন। তখন দুইপক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও মারামারি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে চলে যায় নেতাকর্মীরা।
এরপর ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে তারা ২শ’ শিক্ষার্থী ভেতরে অবস্থান করে। ১৫ জুলাই বেলা ১১টার দিকে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাফিউরকে জানানো হয় ওইদিন রাতে তাদের ক্যাম্পাসের হলে আক্রমণ করবে ছাত্রলীগ। তখন ওইদিন দুপুর ২টার দিকে সব হলে তালা দিয়ে ছাত্ররা ফরিদপুর, বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা সহ বিভিন্ন জেলায় সড়কপথে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে চলে যায়।
তাদের মধ্যে সাফিউর রহমান নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় আশ্রয় নেয়। পরে সেখানকার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে সমন্বয় করে নোয়াখালী চৌরাস্তা মোড়ে ও বেগমগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ২১ জুলাই রাতে জ্বর শুরু হয়। ২৪ জুলাই সাফিউর প্রথমে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে ওইদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ভর্তি হওয়ার পর সকাল দশটার দিকে প্রথমেই তাকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং মুখে বড়ি খাওয়ানো হয়। তারপর বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার নামে বারডেম হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসকরা সাফিউরকে জিজ্ঞেস করেন সে নেশা করে কিনা বা কোনো সময় সে কোনো ড্রাগ গ্রহণ করেছে কি না।
ওই সময় আমার ছেলের শয্যার আশেপাশে অপিরিচত লোকের আনাগোনা দেখা যায়। তারা বিভিন্নভাবে বাবা-ছেলেকে প্রশ্ন করে। মূলত বাবা ও তার ছেলেরে আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করে ওই সমস্ত অপরিচিত লোকজন। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ২৪ জুলাই দুপুরে বাবা-ছেলে ও তার বোন একসাথে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে। মায়ের সাথে দুপুর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কথা বলেছে।
এর মাঝে হঠাৎ করে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাফিউর রহমানের মুখে ফেনা ওঠা শুরু করে এবং লালা বের হতে থাকে। এর মধ্যে কর্তব্যরত চিকিৎসককে জানালে তিনি মুখে খাবার একটি ট্যাবলেট দেন এবং বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে মুখের লালা পরিস্কার করে দিতে বলেন। ২৫ জুলাই ভোররাতে ফজরের আযানের সময় মুত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শাফী। ভোর ৬টার দিকে ছেলের মরদেহ নিয়ে হাসপাতাল থেকে অনেকটা পালিয়ে যেতে হয় তার বাবাকে। তা না হলে ছেলের লাশ না পাওয়ার শঙ্কা ছিল।
সাফিউরের বাবা রেজাউল করিম পাশা বলেন, সাফির মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছে শ্বাসনালীর সংক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছে। যা কখনই সম্ভব নয়। আমার ছেলের যদি শ্বাসনালীর সংক্রমণ থাকতো তাহলে সে নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারতো না। সে কখনও জীবনে একটা ধুমপানও করেনি। মাদক গ্রহণের কথা তো আরো বহুদূর। তার অভিযোগ, ছেলে কোটাবিরোধী আন্দোলন করায় তাকে পরিকল্পিতভাবে পয়জনিং করে মেরে ফেলা হয়েছে। এতদিন নিরাপত্তার শঙ্কায় কারো কাছে মুখ খুলতে পারিনি। এর সঠিক তদন্ত ও বিচার চাই।
সাফিউর রহমানের মা কামরুন্নাহার বলেন, ‘২৪ জুলাই রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ছেলের সাথে শেষ কথা হয়। সে বলছিল, ‘আম্মু তুমি চিন্তা কইরো না। আমি ভাত, স্যুপ ও কফি খাইছি। তুমি কখন আসবে। আমি বলছিলাম আমি কাল সকালে আসবো। আমার একটাই ছেলে কিভাবে চলে গেলো। আমার ছেলে যে নাই আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা। আমি এখনও পথ চেয়ে থাকি, আমার ছেলে ফিরে আসবে।’
এসআই