চট্টগ্রাম: রেঞ্জ রোভার, ল্যান্ডক্রুজার কিংবা বিএমডব্লিউর মতো মূল্যবান বিলাসবহুল এমন ১২১টি গাড়ি ৯ দফা নিলামে তুলেও তা বিক্রি করতে পারেনি কাস্টমস। এরই মধ্যে ৭৫টি গাড়ি কেটে কেজি দরে বিক্রি করতে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। অপেক্ষায় আছে ৪৬টি। এসব গাড়ির বাইরে যেগুলো নিলামে বিক্রি হয়েছে, সেগুলোতেও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত দর। অথচ গাড়িগুলো নিলামে তোলার আগে বাজারদর বিবেচনা করে প্রতিবারই সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর ধারেকাছেও থাকছে না নিলামের দর। তাই বন্দরে এখনও পড়ে আছে নিলামযোগ্য ৩৯৯টি গাড়ি। এর মধ্যে দুটি গাড়ি নিলামে উঠছে আজ।
গত পাঁচ বছরে নিলামে ওঠা তিন শতাধিক গাড়ির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চার কারণে বিলাসবহুল এসব গাড়ির কাঙ্ক্ষিত দাম মিলছে না। চার কারণ হলো– দীর্ঘ সময় পড়ে থেকে গাড়ির লাইফটাইম শেষ হয়ে যাওয়া, এর পর মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র না পাওয়া এবং নিলাম সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকা।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘কোন পণ্য নিলামে উঠবে তা আমাদের জানায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বিক্রির সিদ্ধান্তও নেয় তারা। ফলে কেন বিলাসবহুল গাড়ি পানির দরে কিংবা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, এটা তারাই ভালো বলতে পারবে।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান বলেন, ‘নিলাম প্রক্রিয়া নিয়ে আগে অনেক দীর্ঘসূত্রতা ছিল। এখানে কাজ করত শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটও। আমরা এখন নিলাম আগের তুলনায় অনেক দ্রুততম সময়ে করছি। সিন্ডিকেট ভাঙতে অনলাইনে প্রস্তাব নিচ্ছি। তারপরও প্রত্যাশা অনুযায়ী দর পাচ্ছি না অনেক সময়। তখন এনবিআরের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হই আমরা।’
কখন নিলামে ওঠে গাড়ি: কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, যেসব চালানের পণ্য আমদানিকারকরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খালাস নেন না; কিন্তু ব্যবহার উপযোগিতা থাকে– সেগুলো নিলামে তোলে কাস্টম হাউস। যেসব পণ্য নষ্ট হওয়ায় ব্যবহার উপযোগিতা হারিয়েছে কিংবা বিপজ্জনক, সেগুলো ধ্বংস করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এয়াকুব চৌধুরী জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে আমদানি পণ্য নামার ৩০ দিনের মধ্যে আমদানিকারককে সরবরাহ নিতে হয়। এই সময়ের মধ্যে কোনো আমদানিকারক পণ্য সরবরাহ না নিলে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টমসের নিলাম শাখায় আরএল (অখালাসকৃত চালানের তালিকা) পাঠায়। তখন নিলাম শাখা সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে নোটিশ দেয়। নোটিশের ১৫ দিনের মধ্যেও পণ্য সরবরাহ না নিলে পণ্য নিলামে তুলতে পারে কাস্টমস।
এয়াকুব চৌধুরী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিলাম না হওয়ার কারণে বন্দর ইয়ার্ডে কিংবা কনটেইনারে পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। চুরি হয়ে যায় গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ। আবার নিলামে বিক্রি হওয়া গাড়ির বাণিজ্য ছাড়পত্র দিতে গড়িমসি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। হয়রানি করে বিআরটিএও।
কাটা হচ্ছে বিলাসবহুল ১২১ গাড়ি: চট্টগ্রাম বন্দরে ১৫ বছর ধরে পড়ে ছিল আমদানি করা ১২১টি দামি গাড়ি। এর মধ্যে আছে প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ডাম্প ট্রাক, পিকআপ, স্টেশন ওয়াগন ও সুইপার লরি। সংশ্লিষ্টরা জানান, নিলাম সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় এসব গাড়ি এতবার নিলাম দিতে হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় পড়ে থাকায় এসব গাড়ির লাইফটাইম শেষ হয়ে গেছে। অনেকগুলোর মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এসব গাড়ি ব্যবহারে এখন আর ছাড়পত্র দিচ্ছে না।
কাস্টমসের উপকমিশনার সেলিম রেজা বলেন, ‘গাড়িগুলোর বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি অনুযায়ী, এত পুরোনো গাড়ি নিলামে বিক্রির সুযোগ নেই। এ অবস্থায় বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কাস্টমস নিলাম কমিটি ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এই ১২১টি গাড়ি ধ্বংসের সুপারিশ করে। বিকল্প কোনো পথ না থাকায় আমদানি করা গাড়িগুলো কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে কেজি দরে নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাস্টমস। এমন সিদ্ধান্ত কাস্টমসের ইতিহাসে এটাই প্রথম। শেডে থাকা এই গাড়িগুলোতে বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনা হওয়ার ঝুঁকিও আছে।’
তিনি জানান, প্রথম দফায় ৭৫টি গাড়ি কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে নিলামে বিক্রি করা হবে। মামলা নিষ্পত্তি হলে বাকি ৪৬টিও কাটা হবে।
নিলামে উঠবে ৪৪ এমপির গাড়ি: সদ্য সাবেক হওয়া ৪৪ এমপির আমদানি করা গাড়িও নিলামে উঠতে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের কারণে গাড়িগুলো খালাস করতে পারেননি তারা। আওয়ামী লীগ সরকার টিকলে ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের এসব গাড়ি বিনা শুল্কে খালাস করতেন তারা। তবে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার দিন কয়েক আগে সাকিব আল হাসান, ফেরদৌস আহমেদ ও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনসহ সাতজন এমপি খালাস করে নিয়ে গেছেন সাতটি গাড়ি। আরও চারজন এমপি জমা দিয়েছিলেন তাদের নথি। তবে সেগুলো আটকে দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এখন আর গাড়িগুলো বিনা শুল্কে ছাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।
কাস্টমস সূত্র জানায়, শর্ত সহজ করে গাড়িগুলো বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুল্কসহ এসব গাড়ির প্রতিটির বাজারমূল্য ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। গাড়িগুলোর ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি তিন হাজার থেকে চার হাজার সিসি। এই ধরনের গাড়ির ওপর ৮১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ হয়ে থাকে। কিন্তু এমপিরা পেতেন শুল্কমুক্ত সুবিধা।
এম