গৃহ শিক্ষিকাকে বাদ দেওয়ায় হত্যাকাণ্ড

মুনতাহাকে আর খুঁজবে না নেটিজেনরা

  • সিলেট প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৪, ০৮:০৮ পিএম

সিলেট: গত ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফেরে  ৫ বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন। পরে প্রতিদিনের মতো আশপাশের বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে যায় সে। কিন্তু বিকেল হলেও বাড়িতে না ফিরলে খোঁজাখুঁজি শুরু হয় সব জায়গায়। কোথাও তার সন্ধান না পেয়ে থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয় মুনতাহার পরিবার। তার নিখোঁজ সংবাদ আলোড়নের সৃষ্টি হয় সারাদেশে। ফুটফুটে শিশুকে খুঁজতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের সর্বোত্র থেকে দেয়া হয় হাজারো পোস্ট। সকলেরই আশা ছিল ছোট্ট নিষ্পাপ মুনতাহা আবারও পরিবারের কাছে ফিরবে।  অবশেষে সেটাই হলো। নিখোঁজের ৭ম দিনে ফিরে পাওয়া গেল মুনতাহাকে। তবে সে আর বেঁচে নেই। মাটিতে পুঁতে থাকতে থাকতে ৭ দিনে মুনতাহা ফুলে যায় একেবারে।

শনিবার (৯ নভেম্বর) দিবাগত রাতে সন্ধান মিলে মুনতাহার। তাকে হত্যাকাণ্ডের সন্দেহে একজনকে আটকের পরই তার লাশ অন্য জায়গায় লুকানোর চেষ্টাকালে পাওয়া যায় মুনতাহাকে। এ ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনার সাথে অভিযুক্ত আলিফজান বেগমের ঘর ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। গৃহ শিক্ষিকা থেকে বাদ দেওয়াতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মার্জিয়া ও তার সহকারীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

গ্রেপ্তারকৃত ৪ জন হলেন- একই বাড়ির মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান বেগম (৫৪), তার মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫), মৃত ছইদুর রহমানের পুত্র ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুনুর রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫)। তারা প্রত্যেকেই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।

জানা যায়, শনিবার রাতে মুনতাহাকে নিখোঁজের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই বাড়ির আলিফজান বিবি’র মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে পুলিশ। মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি বসত ঘরের পাশে একটি নর্দমায় পুঁতে রাখা মুনতাহার মরদেহ তুলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টার সময় আব্দুল ওয়াহিদ সহ আরও কয়েকজন হাতে নাতে আলিফজান বিবিকে আটক করেন। তখন নিখোঁজ মুনতাহার মরদেহ দেখে এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।  

পুলিশ ও মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ জানান, শিশু মুনতাহার এক সময়ের গৃহ শিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু তার আচরণ খারাপ আর মেয়ে হিসেবে ছিলো চরিত্রহীন। বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সময় মুনতাহাকে সঙ্গে নিয়ে যেত সে। খারাপ প্রকৃতির হওয়ায় তিনি তাকে মুনতাহাকে পড়াতে মানা করেছিলেন।  এতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার বাবা-মা’র উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজের দিন মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া এবং তার মা আলিফজান বিবি তাদের বসতঘরে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার পর মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি প্যাঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দী করে ঘরের মধ্যে রাখে হত্যাকারীরা।

এরপর গভীর রাতে হত্যাকারীরা মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে বসতঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুতে রাখে। একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়া সহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহা নিখোঁজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলতে থাকে তারা। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে শনিবার রাতে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। মার্জিয়াকে থানায় নিয়ে আসার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুঁতে রাখা মরদেহ তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে আলিফজান বিবিকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান বিবি ও তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। আটক আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত স্থানীয় বীরদলের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন ও একই বাড়ির মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগমকে রবিবার দুপুরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে গ্রেপ্তারকৃত ৪ জনকে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ।

এদিকে রোববার শিশু মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে আসলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।  রোববার বাদ আসর মুনতাহাকে বীরদলের পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজা শেষে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

শিশু মুনতাহাকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আউয়াল।

এদিকে রোববার দুপুরে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান নিহত মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে শান্তনা প্রদান এবং হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এলাকার অনেকের সাথে কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, শিশু মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। মুনতাহার হত্যাকারী ৪ জনকে ইতিমধ্যে আমরা গ্রেপ্তার করেছি এবং এ হত্যাকান্ডের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলেও জানান তিনি।

এসএস