শম্ভুর টাকা কামানো ছিল নেশা, দলের মধ্যে কোন্দল লাগানোই ছিল তার পেশা!

  • তাপস মাহমুদ, বরগুনা | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ১০:৪৮ এএম
ফাইল ছবি

বরগুনা: বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক উপ মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম দূর্নীতি, টি আর, কাবিখা, কাবিটার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে করেছেন শত শত কোটি টাকা। এমপি হয়ে এলাকার উন্নয়নের চেয়ে টাকা কামানোই ছিল তার একমাত্র নেশা। জবরদখল আর নিজ দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে দলীয় কোন্দল লাগিয়ে ক্ষমতা কুঠিগত রাখা ক্যারিশম্যাটি ছিল তার পেশা। শম্ভুর দম্ভে তৃনমুল নেতা কর্মীরা ছিল তটস্থ। দাম্ভিক শম্ভু তাদের কাছে এখন রাজনীতিতে মনস্টার মহালুটেরা হিসেবে আখ্যায়িত।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু রাজনীতির পাশাপাশি আইন পেশায় জড়িত ছিলেন। ১৯৮৫ এবং ১৯৮৮ সালে বরগুনা পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করে দুইবারই হেরে যান। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৭, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেলেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও ডামি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। এছাড়াও তিনি গত ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদটি নিজ দখলে রেখেছেন। 

[237067]

গত তিন দশক দলের সভাপতি ও সংসদ সদস্য থেকে দোর্দন্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংবিধানে লেখা বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বাতিল করতে বক্তৃতা দিয়ে নিজেকে প্রথম দেশবাসীর কাছে বিতর্কিত ও সমলোচিত হন। এরপর সপ্তম সংসদের সংসদ নির্বাচনে এমপি হয়ে খাদ্য উপমন্ত্রী হন। খাদ্য উপমন্ত্রী হয়েই সরকারের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে যত্রতত্র পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে চলাচল করতো। এমন বিতর্কিত ঘটনার সংবাদ প্রকাশ হলে তখনও আবার সমালোচিত হন দেশজুড়ে। 

বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে শম্ভু ও তার পরিবার এবং তার অনুসারীদের একচেটিয়া দাপটে গড়ে উঠেছিল তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন প্রকল্প, টেন্ডার, সবখানে ছিল তাদের ত্রাসের রাজত্ব। 
ক্ষমতার অপব্যাবহার, অনিয়ম দূর্নীতি, জমি জবর দখল করে নিজ ও নিজ পরিবারের নামে দেশে বিদেশে গড়েছেন অবৈধ সম্পদ। শম্ভু এবং তার ছেলে সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে। দুদক শম্ভু ও তার পরিবারের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৫০০ শত কোটি টাকার সম্পদের বিস্তর অভিযোগ পেয়েছে। 

২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তার সম্পদ বেড়েছে ৫গুন। নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফ নামায় সম্পদের হিসাব দিলেও পক্ষান্তরে এর সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। দুদক সূত্রে জানা গেছে আমেরিকায় তার শ্যালক তপন কুমার দেবনাথের কাছেই তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এমনকি সেখানে তার বিলাস বহুল বাড়িও রয়েছে। এছাড়াও ক্ষমতার দাপটে বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদের পুকুর ভরাট করে বাগান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। 

দুদকের কাছে আরও অভিযোগ রয়েছে তার ছেলে সুনাম দেবনাথের অবৈধ সম্পদ ও মাদক কারবারি করে অবৈধ টাকা আয় করার। টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পের ৩৯১টি প্রকল্পের ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার কোন কাজ না করেই আত্মসাৎ করেছেন এমন তথ্য মিলেছে দুদকের গোয়েন্দাদের কাছে। 

বরগুনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এলজিইডি, সড়কও জনপদ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সকল কার্যালয়ে সিংহ ভাগ কাজ করতো তার অনুসারী ঠিকাদাররা। গত পাঁচ বছর ২৬টি ব্রিজ এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি বরগুনাবাসী। এসকল ঠিকাদারি কাজের তদারকি কমিশন বাণিজ্যে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বরগুনায় প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে রয়েছে খানাখন্দ ভরা। এসকল সড়কে মানুষ পায়ে হেটে চলা দায়। যে কয়টি সড়কে মেরামত করা হয় তা আবার বছর শেষ না হতেই অনুপযোগী হয়ে ওঠে তার অনুসারী ঠিকাদারদের তবিয়তে। 

শম্ভুর বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারীতা ও তার ছেলের মাদক কারবারির বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগ তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ২০১৮ সালে ৪ সেপ্টেম্বর। তার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে ২০০১ সালে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বিদ্রোহী প্রার্থী হন এবং বিপুল পরিমাণ ভোটে তাকে পরাজিত করেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও শম্ভুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ৩ জন বিক্ষুব্ধ হয়ে নির্বাচন করেন। এবারে তিনি তৃতীয় হন।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের পর থেকেই তিনি রাজধানীতে পালিয়ে ছিলেন। গত সোমবার রাত ৯টায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার উত্তরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র শ্রমিক জনতার আন্দোলন চলাকালে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ওয়াদুদ নিহত হওয়ার মামলায় ডিবি রমনা জোনের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফ আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত শুনানি শেষে ৬দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। 

তাঁর গ্রেপ্তারের খবর গণমাধ্যমে  প্রকাশ হলে বরগুনায় আওয়ামী লীগ ও  সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা কর্মী  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে পোস্ট দিতে দেখা গেছে। এলাকার মানুষের কাছে তার গ্রেপ্তারের সংবাদটি সুসংবাদে পরিণত হয়েছে। এমনকি তার অন্যায়, অত্যাচার সম্পর্কেও একাধিক লোক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।   বরগুনা জেলা শ্রমিক লীগের আহবায়ক আঃ হালিম মোল্লা লিখেন "বরগুনার শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ গ্রেপ্তার। কথায় বলেনা শয়তান মরে কাউয়া হইয়া। চিনতো না আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীদের। চিনতো না মুক্তিযোদ্ধা, চিনতো না কাউকে। ওর লাগবে শুধু টাকা! টাকা ছাড়া নড়েনা শম্ভু! এমনকি স্ত্রীর কথাও শুনতো না।" শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহবায়ক রাশেদ আহমেদ বশির লিখেন, "অতঃপর রাজনৈতিক মনস্টার মহালুটেরা বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু আটক।" সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী লীগের পদবঞ্চিত মোঃ আল আমিন লিখেন, "রাজনৈতিক নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে ৩০ বছর থাকা যায়, কিন্তু জনগণ ও কর্মীদের হৃদয় থেকে উঠে গেলে, কর্মীদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতও গাছের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়। তার জন্য দুঃখ প্রকাশ।"

বরগুনা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, শম্ভু বরগুনার একজন মহা দুর্নীতিবাজ ও ভারতীয় রয়ের এজেন্ট। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে বিভিন্ন সময় কটুক্তি করেছে। আমরা শম্ভুর গ্রেপ্তারে আনন্দিত। 

বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উজ জামান মামুন মোল্লা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শম্ভু একজন ভোট চোর। ছাত্র জনতার আন্দোলনে খুনের সঙ্গে জড়িত। তার দৃষ্টান্ত মূলক বিচার দাবি করছি।

এ ব্যাপারে বরগুনা ছাত্র সমন্বয়ক মুহিত হাসান নিলয় বলেন, দুর্নীতিবাজ শম্ভু গ্রেপ্তারে আমরা খুশি। ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় যারা লুটপাট করেছে এবং ছাত্র আন্দোলনের সময় যারা ছাত্রদের উপরে নির্যাতন, হত্যা করেছে তাদের সকলকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাই। 

এসআই