লালমনিরহাট মুক্ত দিবস

যেভাবে হানাদারমুক্ত হয়েছিলো লালমনিরহাট

  • সজীব আলম, লালমনিরহাট | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ১০:০৫ এএম

লালমনিরহাট: ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত দিবস।  ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে লালমনিরহাট থেকে পালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।  দখলমুক্ত হয়েছিল উত্তরের সীমান্তবর্তী এই জেলা। তবে পালানোর আগে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালিয়েছিল বর্বর ওই বাহিনী। যার সাক্ষী হয়ে রয়েছে জেলা শহরসহ অন্যান্য উপজেলায় একাধিক গণকবর। এর আগে ৩ মার্চ সকালে পাক হানাদার বাহিনী সড়ক পথে লালমনিরহাট দখল করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬নং সেক্টর শুধু বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর সেটি অবস্থিত লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে।

[238988]

যুদ্ধের আগে উর্দুভাষী বিহারিরা চাকরির সুবাদে রেলওয়ে বিভাগীয় শহর লালমনিরহাটে বসবাস করতো। আর সেই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বিহারিদের সহযোগিতায় সহজেই বাঙালিদের ওপর হামলা চালিয়েছিল এবং বাঙালি নারীদের তাদের পাকিস্তানি ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যেত। আর সেখানে তাদের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হতো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের সহযোগিতা করতো তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। তারা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় বাঙালির সম্পদ লুট করতো।

লালমনিরহাটের বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন জানান, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হেলিকপ্টারে করে লালমনিরহাটে আসে। ওইদিন লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা লালমনিরহাট থানার ওসি মীর মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে যৌথভাবে বাঙালি পুলিশ ও স্থানীয়রা পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ করে। এসময় হামলায় বহু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও অবাঙালিরা নিহত হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা উর্দুভাষী বিহারি ও স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় লালমনিরহাটে গণহত্যা চালায়। এসময় শিশুসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। বাঙালি কিশোরী-তরুণীদের তুলে নিয়ে যায়। 

মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা লালমনিরহাট শহরকে পাক হানাদার মুক্ত করতে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ পরিচালনা করে। মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাকবাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও তাদের দোসর অবাঙ্গালীরা দু’টি স্পেশাল ট্রেনযোগে রংপুর ও সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এরপর লালমনিরহাট জেলা পাকহানাদার মুক্ত হয়।

তবে তিস্তা নদী পার হওয়ার পরে পাক সেনারা তিস্তা রেল সেতুতে বোমা বর্ষণ করে সেতুর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। লালমনিরহাটে ৭১এর এই দিনে এখানে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। লালমনিরহাট শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসতে থাকে শহরের দিকে।

[238990]

সন্ধ্যার মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশন মোড় এলাকায় লোকে পূর্ণ হয়ে যায়। স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহর ও আশ-পাশের গ্রাম। আনন্দে উদ্বেলিত কণ্ঠে স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে তরুণ, যুবক, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলই।

এদিন সকাল থেকে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে লালমনিরহাট শহর, জনপদ ও লোকালয়ের মানুষ জড়ো হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। পরদিন ৭ ডিসেম্বর বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষ জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে ও বিজয়ের পতাকা নিয়ে ঢুকে পড়ে শহরে।

এর আগে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লালমনিরহাট রেলওয়ের অফিস ও আবাসিক এলাকায় রাজাকারদের যোগসাজশে পাকবাহিনী গণহত্যা চালায়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, বুদ্ধিজীবিসহ ৩৭৩জন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে।

বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় সদর দফতর এলাকায় ৩টি গণকবর সমেত বদ্ধভূমি রয়েছে। এসব অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে।

এসএস