কক্সবাজার : পশ্চিমে হেলে পড়েছে লাল সূর্য। সাগরের বালুচরে বসানো চেয়ারে (কিটকট) সেই সূর্যের অপরূপ রূপ উদাস দৃষ্টিতে দেখছেন কেউ। কেউ আবার বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যকে পেছনে রেখে ছবি তোলায় ব্যস্ত।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দেখা যায় এমন চিত্র। বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্রসৈকতে ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়।
বিকেল পাঁচটার দিকে সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, এক কিলোমিটার সৈকতে অন্তত ৫০ হাজার পর্যটকের সমাগম হয়েছে। ভাটার কারণে পানি নেমে যাওয়ায় দেখা দেয় বিশাল বালুচর। সেখানে প্রিয়জনদের নিয়ে বছরের শেষ সূর্যাস্তের মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করতে পর্যটকেরা ব্যস্ত রয়েছেন। সবারই যেন চোখ ডুবন্ত সূর্যের দিকে। বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে ডুবে যায় সূর্য। পর্যটকদের অনেকেই তখন হইহুল্লোড় শুরু করে দেন। অনেকে হাত তুলে বিদায় জানান সূর্যকে। উচ্চ স্বরে অনেককে বলতে শোনা যায়, বিদায় ২০২৪।
বিকেলে সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যকে হাতের মুঠোয় দেখা যায়, এমন করে ছবি তুলছিলেন ঢাকার বাড্ডার একটি স্কুলের শিক্ষক সাবেকুন্নাহার। তাঁকে ছবি তুলে দেন সমুদ্রসৈকতের ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী সোহেল। পরে সাবিকুন্নাহারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও যৌথভাবে কয়েকটি ছবি তুলতে দেখা যায়।
[240813]
সাবেকুন্নাহার (২৫) বলেন, কক্সবাজার সৈকতের মূল আকর্ষণ সূর্যাস্ত উপভোগ করা। বছরের শেষ সূর্যের লাল আভায় সাগরের পানি যেন রঙিন হয়ে উঠে। এমন দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে।
পর্যটকেরা যখন সূর্যের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন তাঁদের নিরাপত্তায় তৎপরতা দেখা যায় বেসরকারি সি-সেফ লাইফ গার্ডের স্বেচ্ছাসেবীদের। যেসব পর্যটক সাগরে নেমেছেন, তাঁদের দিকে খেয়াল রাখছেন তাঁরা। বালুচরে চৌকিতে বসে নজর রাখছেন পানিতে জেট স্কিতে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের।
সৈকতের কলাতলী, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে দাঁড়িয়েও হাজারো পর্যটক বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানান। তবে এবার সমুদ্রসৈকতের উন্মুক্ত স্থানে হয়নি বর্ষবিদায়ের কোনো অনুষ্ঠান। এতে অনেক পর্যটক হতাশা প্রকাশ করেন।
ঢাকার গাজীপুরের বাসিন্দা রমিজ আহমদ বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপনের আশায় পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে তিনি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ছুটে এসেছেন। এখানে এসে জানতে পারেন, এবার সৈকতের উন্মুক্ত স্থানে কনসার্টসহ সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন নেই।
[240823]
সিলেটের জিন্দাবাজারের আজিম উদ্দিন বলেন, সাত বছর আগে তিনি সৈকতে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন করেছিলেন। তখন সৈকতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলেন। এবার এ ধরনের আয়োজন না থাকায় কিছুটা মন খারাপ তাঁর।
কক্সবাজারের সাতটি হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সমন্বিত মোর্চা ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন এবং বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে মঙ্গলবার সৈকতে সমবেত হয়েছেন এক লাখের বেশি পর্যটক। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় আরও ৪০ হাজার নারী-পুরুষ। সবাই সূর্যাস্ত দেখে ২০২৪ সালকে বিদায় জানিয়েছেন।
হোটেলমালিকেরা জানান, ১৩ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ দিনে অন্তত ২৫ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। এ সময় পাঁচ শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট, গেস্টহাউস ও কটেজের কোনো কক্ষ খালি ছিল না। ১ জানুয়ারি বছরে নতুন সূর্যোদয় দেখে বেশির ভাগ পর্যটক ফিরে যাবেন। এর পর থেকে হোটেলকক্ষ ফাঁকা থাকবে।
নানা আয়োজন : বর্ষবিদায়ের মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করেছে পরিবেশবান্ধব ইকোট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান মারমেইড বিচ রিসোর্ট। সেখানকার ৩৩টি কটেজে থাকছেন ৫০-৬০ জন বিদেশি।
রিসোর্টের অভ্যন্তরে ৭০০ ফুট লম্বা সুইমিংপুলের পশ্চিম পাশে উন্মুক্ত বালিয়াড়িতে উৎসবের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ। সমুদ্রের পানিতেও নৌকা, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতি বিজলিবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। পুরো রিসোর্ট আলোকসজ্জায় সজ্জিত। বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে শতাধিক পর্যটক মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করেন।
সূর্যাস্তের পর মঞ্চে শুরু হয় নাচগানের আসর। আতশবাজি, রকমারি বিজলিবাতি জ্বালিয়ে উদ্যাপন করা হয় বর্ষবিদায় উৎসব। একইভাবে রাত ১২টা ১ মিনিটে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন ২০২৫ সালকে। বিদেশি শিল্পীদের ব্যান্ডসংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজনও রয়েছে।
মারমেইড ইকো-ট্যুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার ভ্রমণে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনন্দ দিতে ব্যতিক্রমী আয়োজন হাতে নেওয়া হয়েছে।
[240822]
এর মাধ্যমে কক্সবাজারের পর্যটনকে একদিকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করবে, অন্যদিকে কক্সবাজার আসতে বিদেশিদের উৎসাহিত করবে। রিসোর্টের অতিথি ছাড়াও স্থানীয় ব্যক্তিদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব উপভোগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
কক্সবাজারে শহরের লাবণী পয়েন্টের তারকা হোটেল কল্লোল, সিগাল, ওশান প্যারাডাইস, সায়মান বিচ রিসোর্ট, হোটেল কক্স-টুডে, কক্সবাজার কার্নিভ্যালসহ কয়েকটি হোটেল-রিসোর্টে বর্ষবিদায় ও বরণের অনুষ্ঠান-পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এবারও সৈকতের উন্মুক্ত জায়গাতে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে তারকামানের হোটেল-রিসোর্টে যাঁরা অতিথিদের জন্য কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, সেখানে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
এমটিআই