ঢাকা : আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। শুধু রাজধানী নয়, দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতায় আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। এক শ্রেণির বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক পরিবহন থেকে শুরু করে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর ২৬৪ কিশোর নিহত হয়েছে, যেখানে ২০১৯ সালে একই বয়সি ছেলের নিহতের সংখ্যা ছিল ২২১ জন। আর চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৭২ জন।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. কুদরাত-ই-খুদা বলেন, কিশোর-তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের বিপথগামী হওয়ার আগেই সামাজিক আন্দোলন জরুরি। কিশোরদের অভিভাবকরাও রয়েছেন বেখেয়াল। সন্তান কোথায় সময় কাটায়, কী করে তার কোনো খোঁজ তারা নেন না। সমাজের মুরুব্বি শ্রেণিও তাদের ব্যাপারে উদাসীন।
এছাড়া মোবাইল ফোন তথাপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অনেকে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তারা বলছেন, কিশোররা আমাদের নিকট আতঙ্ক হবে কেন, তারা আমাদের সম্পদ। যে-কোনো মূল্যে এ বিপথগামীদের রুখতে হবে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় অর্ধশতাধিক গ্রুপ, যারা প্রায় প্রতিদিনই মারামারি বা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মাদক ও প্রেম নিয়ে বিরোধের জেরে অহরহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। পাশাপাশি অর্থের বিনিময়ে অর্থদাতার প্রতিপক্ষের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে সম্প্রতি র্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে উত্তরায় সক্রিয় ২২টি ও মিরপুরে ১০টি।
এছাড়া তেজগাঁও, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে।
র্যাব জানায়, ২০২০ সালে বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ২০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ৭১ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৩৭৪ জন সদস্য।
কিশোর গ্যাংয়ের খুনখারাবি : রাজধানীর শনির আখড়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আরাফাত ইয়াসিন (১৮) নামের এক তরুণ খুন হয়। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামে এক কিশোর।
মোবাইল ফোন চুরি নিয়ে রফিকের সাথে কথা কাটাকাটির জেরে নগরীর সুলতান কলোনীতে ইয়াসিনের নেতৃত্ব কয়েকজন কিশোর রফিকুলকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়। গত ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় রাজধানীর কদমতলীর পাটেরবাগ ইতালি মার্কেটের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আহত হন আমিনুল ইসলাম ডালিম নামে ইন্টারনেট এক ব্যবসায়ী। ১০ জানুয়ারি আওলাদ, সাইদুল ও সোয়েব নামের তিনজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে যাত্রাবাড়ীর কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে কয়েকজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ছুরিকাহতে সুমন মুন্সী নামের এক যুবক নিহত হয়। গত ২০ এপ্রিল ধোলাইপাড়ে ফার্নিচার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে পিটিয়ে আহত করে কিশোর গ্যাং লিডার এহসানের গ্রুপের সদস্যরা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বানানী স্টার কাবাবের পাশের রাস্তায় ছুরি মেরে হত্যা করা হয় কিশোর মো. শাকিলকে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কিশোরকে আটক করে পুলিশ। গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে মুগদায় খুন হয় কিশোর মেহেদি হাসান। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ১৫ কিশোরের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এছাড়া গত ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে কারওয়ান বাজার রেলগেটে দুজন ব্যক্তিকে মারধর করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত বছর সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা হত্যার ঘটনায় কিশোর গ্যাং নিয়ে তোলপাড় হয়। একই বছর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোর এবং একই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় শরিফ হোসেন নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও আলোচিত।
গত ২৯ মার্চ শবে বরাতের রাতে রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে অনন্ত (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়। গত মে মাসে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধের জের ধরে মহিউদ্দিন প্রবাল (১৭) নামে এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ছেলেকে হত্যার।
নানা নামে কিশোর গ্যাং : রাজধানীতে নানা নামে কিশোর গ্যাং রয়েছে। এগুলো হলো-পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েস, বিগ বস, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েস, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কে-নাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোটলা বাবু, সুজনা ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল, শাহীন-রিপন এবং নামিজ উদ্দিন গ্যাং, বিহারী রাসেল গ্যাং, বিচ্ছু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুল গ্যাং ইত্যাদি।
র্যাব-পুলিশের তালিকা : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, রমনা বিভাগে সাতটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্য ৬৯ জন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৪টি। লালবাগ বিভাগে ‘ইয়ামিন কিশোর গ্যাং’ গ্রুপে রয়েছে ১১ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে পাঁচটি। ওয়ারীতে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৬৯ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩টি। মতিঝিল বিভাগে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সাতজন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ছয়টি। তেজগাঁও বিভাগে রবিন গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের আটজন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে একটি।
মিরপুর বিভাগে রবিন গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ১০ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। গুলশান বিভাগে কিশোর গ্যাংয়ের একজন সদস্য রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি। উত্তরা বিভাগে বিগ বস গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৫৫ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি।
র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিএমপিতে বিভিন্ন নামে ১১টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের তালিকা করা হয়েছে। এগুলোর মোট সদস্য ২৩০ জন। তাদের বিরুদ্ধে মোট মামলা সংখ্যা ৪৫টি।
টাকা দিয়ে কিশোর গ্যাং পালছে : দুই বছর লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন রাজিব চৌধুরী বাপ্পি ওরফে লন্ডন বাপ্পি (৩৫)। এরপর দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘ডি কোম্পানি’ বা ‘ডেয়ারিং কোম্পানি’। তার গ্রুপে রয়েছে ৫০ জনের বেশি সদস্য। প্রত্যেকে সপ্তাহে তিনশ থেকে চারশ টাকা করে পেত। এই সদস্যদের দিয়ে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক বিক্রি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালানো হতো।
মিরপুরের কাউন্সিলর মানিক এখন আতঙ্কের নাম। বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা ও ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমান উল্লাহ আমানের ছত্রছায়ায় পল্লবীতে গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। প্রতিটা কিশোর গ্যাং প্রধানদের ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করেন কাউন্সিলর মানিক ওরফে বোমা মানিক। মিরপুর-১১-তে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে ইমরান তালুকদার ওরফে লাদেন সোহেল।
হোসেন মনির বাবু ওরফে পিস্তল বাবু, কূখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আরমান, তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী ও হত্যা মামলার আসামি লেঙরা রুবেল, গলাকাটা পারভেজসহ তালুকদার বাহিনীতে রয়েছে অর্ধশতাধিক কিশোর ও যুবক। মূলত মাদক ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে সায়েস্তা করার কাজে তালুকদার বাহিনীকে ব্যবহার করেন মানিক।
কাউন্সিলর মানিক ও জুয়েল রানার হয়ে মিরপুর সেকশন ১০ এর কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রদল নেতা পল্টন । এ গ্যাংয়ে মাদক ব্যবসায়ী মফিজ ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রাজিব, মিজান, বাপ্পিসহ প্রায় ২০০ এর অধিক যুবক কিশোরদের নিয়ে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছে ছাত্রদল নেতা পল্টন। সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা রয়েছে। ইতিবাচক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ অপরাধ দমনে কাজ করছে। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকবে না।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় তাদেরও আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে র্যাব।
তিনি আরো বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষত পরিবারে সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের নজরদারি বাড়াতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কিশোর অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদও কিশোর গ্যাং নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি র্যাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন বড় সমস্যা কিশোর গ্যাং। পরিবারকে জানতে হবে তার ছেলে বা মেয়ে কার সঙ্গে মেশে, কখন কী করে, কোথায় যায়; এটা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল (পিতা-মাতার দায়িত্ব)। সন্তান জন্ম দিলে দায়-দায়িত্ব বাবা-মাকে নিতেই হবে। দায়িত্ব নেবেন না, তবে জন্ম দিয়েছেন কেন? এটি বাবা-মার সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।’
বয়সে কিশোর অথচ অপরাধ করে বেড়াচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন পাশাপাশি বড় ভাই যারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে তাদেরও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন তিনি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই