মানসিক ভারসাম্যহীন নারী

আড়ালে থেকে যান ধর্ষিতারা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২১, ১২:৩২ পিএম

ঢাকা : ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের অনেকেই ধর্ষণের শিকার হলেও এসব ধর্ষণের কোনো মামলা হয় না। ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হওয়া এসব নারীর সন্তান দত্তক নিতে নিঃসন্তান দম্পতিদের আগ্রহ থাকে অনেক বেশি। কিন্তু ওই নারীর বিচার পাওয়া কিংবা চিকিৎসার দায়ভার নিতে চায় না কেউ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ২৪ জন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে মা হয়েছেন। এসব ঘটনায় মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। একটিতে আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ‍পুলিশ। অপরটি বিচারাধীন। এমন ঘটনায় জন্ম হওয়া ২৪ নবজাতকের মধ্যে ৮ জনকে আদালতের নির্দেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে।

দেশের সবকটি বিভাগে ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণের তথ্য মিলেছে। অনেককে প্রকাশ্যে মারধরও করা হয়। মার্কেটের করিডোর, পরিত্যক্ত ভবন ও সড়কের পাশে ধর্ষণ করা হয়েছে অনেককে। এ নারীরা অভিযোগও দিতে পারেন না। গুছিয়ে কাউকে ঘটনাও বলতে পারেন না। উল্টো বেশিরভাগ লোকজন তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, প্রতিটি নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং এসব ছিন্নমূল নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলে অনেকে ধরা পড়ত। এক্ষেত্রে পুলিশ নবজাতকের ডিএনএ টেস্ট করে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। তবে এ অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।

২০১৯ সালে বান্দরবান সদরে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী আসেন। শাহী মসজিদ মার্কেট এলাকায় থাকতেন তিনি। ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারেন ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা। একজন ব্যবসায়ী তার দোকানে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ দেখা শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন এক ব্যক্তি। ধর্ষকের পরিচয় শনাক্ত করেন ব্যবসায়ীরা। তার নাম জামাল হোসেন। খবর দেওয়া হয় থানায়। মামলা করে পুলিশ। জামাল ধরাও পড়ে।

পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর হস্তান্তর করতে চাইলে ওই নারীর পরিবার তাকে নিতে অস্বীকার করে। এরপর সমাজসেবা অধিদপ্তরের আশ্রয়ন কেন্দ্রে রাখা হয় তাকে। ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর ওই নারী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। বান্দরবান থানা পুলিশ জামালকে আসামি করে এ বছরের ২ মে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। আদালত ডিএনএ টেস্ট করে সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করার আদেশও দিয়েছিলেন। মা ও নবজাতক এখনো সমাজসেবা অধিদপ্তরে সেফ হোমে রয়েছেন।

দেশের সবকটি বিভাগেই এমন বর্বরতা প্রমাণ মিলছে। গত আড়াই বছরে ঢাকায় ছয়জন, চট্টগ্রামে চারজন, রাজশাহীতে পাঁচজন, খুলনায় দুজন, সিলেটে তিনজন এবং বরিশালে চারজন ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।

মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের সন্তান দত্তক নেওয়ার আগ্রহ বেশি নিঃসন্তান দম্পতিদের। কারণ এতে দত্তক প্রক্রিয়ায় জটিলতা কম ও পরে কোনো সমস্যা হয় না। মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর সন্তান দত্তক পেয়েছেন এমন এক দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দত্তক নিতে পেরে তারা খুশি। কারণ তাদের ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে কম।

পুলিশ জানিয়েছে, এসব ভবঘুরে মানসিক রোগীদের সন্তান প্রসবের খবর প্রচার হলেই নিঃসন্তান দম্পতিরা দেশ-বিদেশ থেকে ফোন দেওয়া শুরু করে। পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে দত্তক নেওয়ার পরামর্শ দেয়।

বাংলাদেশে সন্তান দত্তক নেওয়ার আইন নেই। তবে অভিভাবকত্ব পাওয়া যায়। তবে এজন্য আদালত কিছু শর্ত দেয়। পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসব বিবেচনা করা হয়।

রাজশাহীর বিভিন্ন জেলায় পাঁচ নবজাতকের দুজন, খুলনার দুই নবজাতকের মধ্যে দুজন, সিলেটে তিন নবজাতকের মধ্যে একজন এবং বরিশালে চার নবজাতকের একজনকে দত্তক দেওয়া হয়েছে।

গত আড়াই বছরে ২৪ জন অপ্রকৃতিস্থ ভবঘুরে নারীর ধর্ষণের শিকার হলেও প্রকৃত ঘটনা আরো বেশি বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। এসব ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি বরগুনায়, অপরটি বান্দরবানে। বরগুনার বামনা থানায় দায়ের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানের মামলাটির অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।

এসব নারীদের নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবনে প্রদানে সমাজসেবা অধিদফতরের অর্থসহায়তা, চিকিৎসা ও আশ্রয় প্রদান করার বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। তবে সেসব সেবা দেশে অপ্রতুল।

অধিদপ্তরের (সামাজিক নিরাপত্তা শাখা) অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের বিভাগ থেকে তাদের ভাতা দিয়ে থাকি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান শাখা তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। তিনি আরো বলেন, কোথাও যদি এমন নারী দেখা যায়, তবে আমাদের খবর দিলে আমরা তাদের আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহযোগিতায় ভবঘুরে নারীদের ঘরে ফেরাতে কাজ করেন মাহসান স্বপ্ন। তিনি বলেন, আমি যতটা পারি এসব নারীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সহযোগিতা করি। কারণ বাইরে থাকলে তারা নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই