মানবপাচার প্রতিরোধে শুরু হচ্ছে ত্রিমুখী অভিযান

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২২, ০২:০১ পিএম

ঢাকা : মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রামের দালাল থেকে শুরু করে শহরের ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ত্রিমুখী অভিযানে নামছে।

বিশেষ করে সিআইডি, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একযোগে এ অভিযান পরিচালনা করবে।

গত বৃহস্পতিবার লিবিয়া থেকে ফেরত ১১৪ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এ অভিযান শুরু হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব মানবপাচার প্রতিরোধে এর আগেও কাজ করেছে। লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশিরা যে তথ্য দিয়েছে তারই আলোকে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরালো করেছে। দ্রুত মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

তিনি বলেন, যারা রঙিন স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে দেশের মানুষকে বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে এদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সূত্র মতে, গত ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে একদল মানব পাচারকারী। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন।

মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনার পর মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ৩০ জানুয়ারি মাদারিপুরের ৭ জন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালি যাওয়ার পথে ঠান্ডায় মৃত্যু হয়। মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পিয়ারপুর গ্রামের ইমরান হোসেন, পিয়ারপুর গ্রামের রতন জয় তালুকদার, ঘটকচর গ্রামের সাফায়েত, মোস্তফাপুর গ্রামের জহিরুল, মাদারীপুর সদর উপজেলার বাপ্পী, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মামুদপুর গ্রামের সাজ্জাদ ও কিশোরগঞ্জে ভৈরব উপজেলার সাইফুল। এ ঘটনা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকহারে প্রচার পায়।

বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়িত অভিবাসন প্রত্যাশি বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এক শ্রেণির মানবপাচারকারীরা দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসা দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছে। কেউ লিবিয়া গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে আবার কেউ সাগর পাড়ি যাওয়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে প্রবেশের সময় সে দেশের পুলিশের হাতে আটক হচ্ছে।

এতে করে একদিকে যেমন ব্রিবত হচ্ছে সরকার তেমনি প্রশ্নের মুখে পড়ছে পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ।

চলমান এ অবস্থার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার লিবিয়া জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে ১১৪ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এ ১১৪ জন দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে প্রথমে দুবাই যান।

এরপর ইটালি যাওয়ার জন্য নেওয়া হয় লিবিয়ায়। আর সেখানেই তাদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পাচারকারীরা নির্যাতনের সেই ভিডিও স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে আদায় করতো মুক্তিপণ।

এভাবে একেক পরিবারের নিকট থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ করে টাকা আদায় করা হতো। পরবর্তীতে সে দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তারা জেলখানায় বন্দি ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস, সেনাবাহিনী ও আইওএম যৌথভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনে।

এদিকে এ ঘটনায়ও বিব্রত সরকার। সরকারের উচ্চ মহল থেকে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে দেশে আসার পর বিমানবন্দরেই তাদের নিকট থেকে নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।

আর সেই তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় দালাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কোনো কোনো ট্রাভেল এ মানবপাচারের জড়িত তাদের তালিকা শুরু হয়েছে। তালিকা ধরেই অভিযান চালাবে সিআইডি, র্যাব এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, তালিকা ধরে আমরা কাজ শুরু করেছি। রাজধানী জুড়েই ট্রাভেল এজেন্সিদের কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রাপ্ততথ্যের ভিত্তিতে মানবপাচারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বরাবরই সিআইডির শক্ত অবস্থান। এর আগে আমরা মানবপাচারকারী অনেক বড় বড় সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছি। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে সিআইডি আবারো নজরদারি শুরু করেছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মানবপাচারে জড়িত ট্রাভেল এজেন্সির তালিকাও তৈরি করা শুরু করেছি। নজরদারির মধ্যেই যেকোনো সময় আমরা বড় সিন্ডিকেটকে আইনের আনতে পারবো।

ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, লিবিয়া থেকে ফেরত আসাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য নিয়ে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানবপাচারকারীদের কোনোভাবে যেন ছাড় না পাই তার ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রামের দালাল থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনতে কাজ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ট্যুরিস্ট ভিসায় দেশের বাইরে যাওয়ার ফিরে না এসে সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাওয়া। এক শ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির কারসাজিতে পড়ে একদিকে যেমন নিঃস্ব হচ্ছে হচ্ছে সাধারণ পরিবার অন্যদিকে বিদেশে এভাবে গিয়ে তারা জেল হাজতে থাকছে। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে।

তিনি বলেন, অনেক সময় তারা মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশি ফেরত আসার ঘটনায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, এটি মানবপাচারের সামিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ট্যুরিস্ট ভিসার ক্ষেত্রে লোকজন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ কিছু বললেই তারা হয়রানীর অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে ইমিগ্রেশন পুলিশ আরো কঠোর হবে। পাশাপাশি যে সকল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইউরোপ যাওয়ার এ প্রবণতা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে আখ্যা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (এআইজি) আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, এক শ্রেণির দালাল ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার কারণে এই বিষয়টা হচ্ছে। তারা ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের দেশের তরুণ যুবকদের প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে। এতে করে কেউ কেউ মৃত্যুর মুখেও পতিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানে ইমিগ্রেশন পুলিশও অনেক সময় দ্বায় নিতে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইমিগ্রেশন পুলিশ যদি যেতে না দেয় তাহলে অভিযোগ করে আবার যেতে দিলে বলে টাকা খায়। এ অবস্থায় তারাও দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে থাকে। তবে এটি নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা নিয়ে একদিকে সরকারকে কাজ করতে হবে অন্যদিকে এর কুফল নিয়ে গণমাধ্যমে বার বার সংবাদ প্রকাশ হলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা আসবে।

তিনি বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভ্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই