ঢাকা : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ডেফারেল সুবিধায় নেয়া ঋণ পরিশোধে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে দুই প্রস্তুাব দিয়েছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। তাদের প্রস্তাব মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধনের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হোক। এব্যাপারে বিএবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দিয়েছে।
এর আগে ডেফারেল পদ্ধতিতে গত বছরের পুরোটা সময় ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত ছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ নীতি ছাড়ের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর দাবি করেছিলেন তারা। যদিও ব্যাংক নির্বাহীদের অনুরোধ আমলে নিয়ে সে পথে হাঁটেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় ছাড়ের সময় আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে বাড়ানো হয়েছে মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিএবি।
বিএবি প্রস্তাব দিয়েছে, ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই চলতি মূলধনের অর্থ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে তিন বছরের জন্য পুনঃতফসিল করে দিতে হবে। একই সঙ্গে মেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও দিতে হবে ন্যূনতম তিন বছর। বিএবির বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে এ প্রস্তাব সংবলিত চিঠি পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশই দেয়া হয়েছে চলতি মূলধন হিসেবে। এ ঋণ এক বছরের মধ্যেই ব্যাংকে ফিরে আসার কথা। চলতি মূলধনের পুরো অর্থ যদি তিন বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করে দেয়া হয়, তাহলে ব্যাংক খাতের সব ঋণই পরিণত হবে মেয়াদি ঋণে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক আমানতের সিংহভাগের মেয়াদই এক বছরের নিচে। এ অবস্থায় সব ঋণকে মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা হলে দেশের অনেক ব্যাংকই তারল্য সংকটে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এফবিসিসিআই, বিজিএমইএসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নরের কাছে এ চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানালেন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, দেশের সবক’টি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের নিয়ে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। বৈঠকে ব্যাংক এমডিদের সংগঠন এবিবির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছি। গভর্নরকে বিএবি থেকে যে চিঠি দেয়া হয়েছে, সেটি দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই।
এব্যাপারে ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনটির বিষয়ে এক বৈঠক আয়োজন করে বিএবি। ওই বৈঠকে দেশের সবক’টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে এবিবির সাধারণ সম্পাদক ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আরএফ হোসেনসহ কয়েকজন শীর্ষ নির্বাহী উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএবি থেকে গভর্নরের কাছে চিঠি দেয়া হয়।
বিএবি চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার স্বাক্ষরিত চিঠির ভাষ্য হলো, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলে গোটা অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী ও দূরদর্শী উদ্যোগের ফলে শিল্প, ব্যবসা ও ব্যাংক খাতসহ পুরো অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কভিড-১৯-এর ভয়াবহ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়া সংক্রমণও এখনো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনো অর্ধেক বা তারও কম সক্ষমতা নিয়ে চলছে অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
চিঠিতে বলা হয়, করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর গড় বিক্রিতেও এর ভীষণ প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় তাদের দৈনন্দিন ব্যবসায়িক খরচ মিটিয়ে মুনাফা আদায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গার্মেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর কার্যাদেশ কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ। ইউরোপ-আমেরিকায় কভিড-১৯-এর প্রকোপে সব ধরনের খুচরা বিক্রি এ মুহূর্তে নিম্নগামী। এ অবস্থায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে বিদ্যমান ঋণগুলো শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি কাটাতে দুটি বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ধরছে বিএবি।
প্রস্তাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপন সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে বিএবি বলেছে, জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট মেয়াদের অর্ধেক বা দুই বছর (যেটি কম) অতিরিক্ত সময় মঞ্জুর করা হয়েছে। এতে যেসব ঋণের মেয়াদ বেশি, সেগুলোর ক্ষেত্রে গ্রাহকরা নিঃসন্দেহে কিছু সুবিধা পাবেন। কিন্তু যাদের অবশিষ্ট মেয়াদ খুবই কম, তাদের ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ে বিরাট অংকের ঋণ পরিশোধ করা খুবই দুষ্কর হবে। এ কারণে এসব ঋণের বড় একটি অংশের অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় উদ্যোগটিকে আরো ব্যবসাবান্ধব ও বাস্তবসম্মত করতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য নগদ প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে কমপক্ষে আরো তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে চলমান বা তলবি ঋণের পাশাপাশি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের বাইমোয়াজ্জাল, বাই-মুরাবাহাসহ যেসব ঋণ এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়, সেগুলো সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এ কারণে ব্যাংকের মোট ঋণের ৬৫-৭০ শতাংশ ঋণ এ নির্দেশনার আওতার বাইরে থেকে গিয়েছে। ফলে গত এক বছরে করোনা মহামারীর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের চলমান বা তলবি ঋণ পরিশোধের যে অতিরিক্ত সময় পেয়েছে, তা এককালীন পরিশোধ করতে না পারলে চলতি বছরের শুরুতেই মেয়াদোত্তীর্ণ বা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয় বলে উল্লেখ করেছে বিএবি।
বিএবির আশঙ্কা, এক বছরে জমে থাকা সুদ-মুনাফা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীই খেলাপি হয়ে পড়বেন ও ব্যবসা চালানোর জন্য সব ধরনের ব্যাংকঋণের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সক্ষমতা হারাবেন। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসার ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। এজন্য চলমান ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশ শূন্য ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে মেয়াদি ঋণ হিসেবে ন্যূনতম তিন বছরে পুনঃতফসিল করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠনটি।
আইন অনুযায়ী চলতি মূলধনের সর্বোচ্চ মেয়াদ এক বছর। সে হিসেবে কোনো গ্রাহক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ নিলে তা এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু করোনার কারণে অন্য ঋণের মতোই চলতি মূলধন পরিশোধে বছরব্যাপী ছাড় পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ২০২০ সালজুড়েই ভালো গ্রাহকরা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ডেফারেল সুবিধায় নেয়া ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণের ৭৭ শতাংশে ডেফারেল সুবিধা নেননি।
সোনালীনিউজ/এএস