সংকট কাটানোর চেষ্টায় চামড়া খাত কোম্পানিগুলো

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১১, ২০২১, ০১:২৫ পিএম

ঢাকা : করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) সৃষ্ট মহামারীতে চামড়া খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় ধস নেমেছে। দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোও মহামারীর মধ্যে বড় লোকসানে নিমজ্জিত। করোনার প্রকোপে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চামড়া খাতের কোম্পানিগুলোর সংকটে পড়ার চিত্র তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তবে এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা সংকট ঈদ বাজারের মাধ্যমে কিছুটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন তারা।

সারা বছর যে বিক্রি হয় তার ২৩-২৭ শতাংশই হয় ঈদ উৎসবে। এই ঈদ উপলক্ষে বাটা পুরুষ, নারী ও শিশু ক্যাটাগরিতে ৫০০র বেশি নতুন ডিজাইন নিয়ে এসেছে। বেস্ট কালেকশনগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই চামড়া খাতের কোম্পানিগুলোর বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে মূল ধাক্কা আসে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে। এসময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিক্রি শূন্যের কোঠায় নামে। এরপর প্রায় এক বছর কেটে গেলেও সেই ধকল আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেশিরভাগ কোম্পানি।

তারা বলেন, চলমান হিসাব বছরের পুরো সময় গেছে করোনার মধ্য দিয়ে। এসময় অর্থনৈতিক কার্যক্রম চললেও জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। আবার কাজে থাকা অনেকের আয় কমে গেছে। সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে।

তারা আরো বলেন, পরিস্থিতি যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার দিকে যাচ্ছিল এবং রোজার ঈদ সামনে রেখে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান যখন নতুন করে বিনিয়োগ করছিল, তখন হঠাৎ করেই আবার করোনার প্রকোপ বাড়ে। ফলে কোম্পানিগুলোর প্রত্যাশিত বিক্রি শঙ্কার মধ্যে পড়েছে।

এরপর বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকার কথা চিন্তা করে সরকার মার্কেট-শপিংমল খুলে দেওয়ায় ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সারাবছর যে বিক্রি হয়, তার প্রায় ৩০ শতাংশ হয় রোজার ঈদে।

এ কারণে রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ কোম্পানি নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পণ্যেও বৈচিত্র্য এনেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সবাই ধরে নিয়েছে এবারের বিক্রিও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম হবে। তবে গত বছরের তুলনায় ভালো হবে।

আমরা সারা বছর যে ব্যবসা করি তার ৩০-৪০ শতাংশই হয় পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদে। করোনার কারণে এবার ঈদকেন্দ্রিক বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে এবার গত বছরের তুলনায় বিক্রি ভালো। চাঁদ রাত পর্যন্ত বিক্রি চলবে। ঈদকেন্দ্রিক কী পরিমাণ বিক্রি হবে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না দেশের বাজারে চামড়াজাত পণ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে বহুজাতিক কোম্পানি বাটা।

করোনার প্রকোপের মধ্যে এই কোম্পানিটিই সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছ ৮৯ টাকা ২৩ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ২৩ টাকা ৫১ পয়সা।

বড় ধরনের সংকটে পড়া এই কোম্পানিটি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঈদ উপলক্ষে ৫০০র বেশি নতুন ডিজাইনের জুতা নিয়ে এসেছে। ঈদকেন্দ্রিক বিক্রি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির দায়িত্বশীলরা। তবে ঈদ বাজারের ব্যবসা দিয়ে করোনার ক্ষতি কতোটা কমানো সম্ভাব হবে তা জানতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ঈদ বাজারে বিক্রির প্রভাব উঠে আসবে জুন মাস শেষে তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদনে।

বাটা সু’র বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপক মো. জুবায়ের ইসলাম বলেন, সারা বছর যে বিক্রি হয় তার ২৩-২৭ শতাংশই হয় ঈদ উৎসবে। এই ঈদ উপলক্ষে বাটা পুরুষ, নারী ও শিশু ক্যাটাগরিতে ৫০০র বেশি নতুন ডিজাইন নিয়ে এসেছে। বেস্ট কালেকশনগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা মেনে আমরা সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি। ২০২০ সালের তুলনায় এবার বিক্রি বেড়েছে। তবে ২০১৯ সালের তুলনায় বিক্রি কম।

নাম প্রকাশ না করে বাটা সু’র আরেক কর্মকর্তা বলেন, করোনায় বাটা যে সমস্যায় পড়েছে, অতীতে কখনো এমন সমস্যায় পড়েনি। ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করা বাটা চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে শেয়ারপ্রতি ৮৯ টাকার ওপরে লোকসান করেছে। তবে আশার কথা ঈদকেন্দ্রিক এবার ভালো বিক্রি হচ্ছে। এতে হিসাব বছর শেষে লোকসান অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে জুন শেষে।

লোকসানের কারণ হিসেবে বাটা সু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনার কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় এই লোকসান হয়েছে।

শুধু বাটা সু নয়, করোনার নেতিবাচক প্রভাব উঠে এসেছে তালিকাভুক্ত চামড়াখাতের অন্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনেও। বাটাসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চামড়াখাতের কোম্পানির সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে একটি কোম্পানি হিসাব বছর গণনা করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর। বাকি পাঁচটির হিসাব বছর জুলাই-জুন। কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান হিসাব বছরে একটি বাদে সবকটির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাটা সু’র পাশাপাশি দেশের বাজারে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা আরেক প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। এই কোম্পানিটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪ টাকা ৬৮ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৬ টাকা ৩৪ পয়সা। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা আগের হিসাব বছরের তুলনায় ১ টাকা ৬৬ পয়সা কমে গেছে।

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার মুনাফা করলেও লোকসানের মধ্যে পড়েছে একই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ট্যানারি। এই কোম্পানিটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৪৮ পয়সা। তবে ভালো খবর হলো, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৮৬ পয়সা মুনাফা করেছে। কিন্তু আগের ছয় মাসে বড় লোকসান করায় কোম্পানিটিকে লোকসানের মধ্যেই থাকতে হয়েছে।

এখন ঈদ বাজারের পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কী পরিবর্তন হয়, তা-ই দেখার বিষয়।

করোনা সংকটের মধ্যে চলমান হিসাব বছরে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়া চামড়াখাতের একমাত্র কোম্পানি ফরচুন সুজ। ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ৫ পয়সা, যা আগের হিসাব ছরের একই সময়ে ছিল ৬১ পয়সা।

চামড়াখাতের অপর দুই কোম্পানির মধ্যে সমতা লেদার চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৩ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৫ পয়সা মুনাফা করে। তালিকাভুক্ত চামড়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটিই একমাত্র যার আর্থিক হিসাব বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর।

আরেক প্রতিষ্ঠান লিগ্যাসি ফুটওয়্যার। এই কোম্পানিটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৯ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৩৬ পয়সা। সে হিসাবে কোম্পানিটির মুনাফা আগের হিসাব বছরের তুলনায় কমে চার ভাগের একভাগে নেমেছে।

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের কোম্পানি সচিব ওমর ফারুক বলেন, আমরা সারা বছর যে ব্যবসা করি তার ৩০-৪০ শতাংশই হয় পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদে। করোনার কারণে এবার ঈদকেন্দ্রিক বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে এবার গত বছরের তুলনায় বিক্রি ভালো। চাঁদ রাত পর্যন্ত বিক্রি চলবে। ঈদকেন্দ্রিক কী পরিমাণ বিক্রি হবে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই