ঢাকা : করোনা মহামারীর মধ্যে বিনিয়োগ অনেকটা থমকে গেছে। করোনাকালের আগে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ হয়েছে, মহামারীর সময়ে তা নেমে এসেছে ৯ শতাংশের কাছাকাছি।
এছাড়া সরকার যে সোয়া লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা বিতরণ হয়েছে ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে আর এ কারণেই বিতরণ করা অঙ্কটা বেশ স্ফীত দেখাচ্ছে। তবে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের পরও ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ শতাংশ থেকে বেশ দূরে ব্যাংকগুলো।
অন্যদিকে আমানতের সুদ হার কমলেও ব্যাংকে এখন উপচে পড়ছে টাকা। বছর পাঁচেক আগেও আমানত সংগ্রহে ব্যাংকগুলো ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দিত। তবে ঋণের সুদ হার এককের ঘরে নামিয়ে আনতে সরকার চাপ দেওয়ার পর আমানতের সুদ হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা।
সুদ হার কমলে আমানত পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদে করোনার মধ্যেও টাকার ঢল নেমেছে ব্যাংকে।
ঋণ কম বিতরণ আর আমানতের ঢেউয়ের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে তারল্য বেড়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চ শেষে তারল্য ছিল ৮৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। চলতি বছর মার্চের শেষে সেটা বেড়ে ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
আমানতের সুদহার কমে এলেও ভালো বিকল্প না থাকায় নিশ্চিত মুনাফা ও নিরাপদে টাকা ফেরতের আশায় কিছু ব্যাংকে আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ডিমান্ড ডিপোজিট (যখন-তখন তোলা যায়) ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর টাইম ডিপোজিট (মেয়াদি আমানত) ১১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চ শেষে আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমানতে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ব্যাংকগুলো থেকে আমানত উত্তোলনের চাপ বেড়ে যায়। ফলে মার্চে সেটা কমে ৮৯ হাজার ৯০৯ টাকায় নেমে যায়। এমন অবস্থায় ১ এপ্রিল থেকে কমানো হয় ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর)। ফলে এপ্রিল শেষে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে হয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর তারল্য টানা বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে যা আরো বেড়ে হয় ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ও আগস্টে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের মার্চ শেষে তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এক বছরের ব্যবধানে তারল্য বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
এর মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে তারল্য ৬১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের রয়েছে ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ২৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। আর ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকার তারল্য জমা হয় বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চাহিদামতো সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড, কলমানি ও অন্য ব্যাংকে আমানত হিসেবেও রাখতে পারছে না। এতে জমা টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে কিছু ব্যাংক।
তবে তারল্য নিয়ে সব ব্যাংকের পরিস্থিতি এক নয়। অনেক ব্যাংক টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। গ্রাহক থেকে আমানত না পেয়ে বেশি সুদে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারি বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদ হার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদ হারও নেমেছে ১ শতাংশে।
২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয় ১০ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার। চলতি মার্চে সেটা বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে ঋণ বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকারও কম। অথচ এই সময়ে প্রণোদনার ঋণই বিতরণ হয়েছে এর চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এটি গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল।
চলতি অর্থবছরেও বেসরকারি খাতের ঋণে শনির দশা চলছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ১১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি স্মরণকালের সর্বনিম্ন।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারীতে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। ফলে বেসরকারি খাত সংকুচিত হয়েছে। আবারো সরকারও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। বিপরীতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোয় অলস অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।
তবে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে না পারলে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ ছিল ব্যাংকগুলোর কাছে। কিন্তু সে পথেও সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, তার ৪০ শতাংশের মতো বিনিয়োগ হয়েছে এখন পর্যন্ত।
মার্চ মাসে ব্যাংক খাতে ঋণ আমানত অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকের হাতে ১০০ টাকা থাকলে ঋণ হিসেবে বিতরণ হয়েছে ৭২ টাকা ৮২ পয়সা।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ১০০ টাকায় ৮৭ থেকে ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে ব্যাংককে।
এই এডিআর রেশিও (অনুপাত) আবারো প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকে বেশি।
প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে এই হার ৬৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, আর ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ৮৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গত বছরের মার্চে এডিআর রেশিও ছিল ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এরপর ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় এ অনুপাত কমতে থাকে। ডিসেম্বর শেষে এডিআর রেশিও কমে ৭২ দশমিক ৬৯ এ দাঁড়ায়।
অবশ্য এর মধ্যেও ১১টি ব্যাংকের এডিআর রেশিও বেশি। এগুলো হলো-বেসিক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, এবি, ওয়ান, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর। বিনিয়োগ বাড়ছে না, এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কারণ বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।
তিনি বলেন, ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ও মাঝারিদের সমস্যা না হলেও কুটির, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) খাতে ঋণ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে ঋণের প্রসার বাড়াতে পারে।
বিকল্প পথেও বিনিয়োগ বাড়ানো যায় বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা নতুন কোনো প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে পারে। তবে আমাদের ব্যাংকারদের এই সৃজনশীলতা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। টাকা নিয়ে বসে থাকবে, কেউ ঋণ নিতে আসবে না। নতুন নতুন প্রোডাক্ট চালু করলে বিনিয়োগ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা বিনিয়োগ করতে চাই; কিন্তু বিনিয়োগ যে করব, সেই চাহিদা তো থাকতে হবে। দেশে এ মুহূর্তে বড় কোনো শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। এজন্য ব্যাংকে অলস টাকা বাড়ছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই