যে কারনে করনোর মধ্যেও বেড়েছে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২১, ০২:২৩ পিএম

ঢাকা : চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানু-জুন’২০২১) দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। চলমান করোনা মহামারির মধ্যেও অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশও ছাড়িয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বরাবরের মতোই এবারো দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এক্সিম, এনসিসি, ঢাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী, যমুনা, এসআইবিএল ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে।

তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গতকাল পর্যন্ত নিজেদের অর্ধবার্ষিকীর হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। এজন্য এ ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার চিত্র জানা সম্ভব হয়নি।

পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ এবং সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর পরিশোধের পর ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার হিসাব হয়। নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। ফলে এসব ব্যাংকের মুনাফা নিয়ে শেয়ারবাজারে ব্যাপক আগ্রহ থাকে। অবশ্য মূল্য সংবেদনশীল বিবেচনায় শেয়ারবাজারে থাকা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগেভাগে প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়ার তথ্য মিলেছে।

মহামারির কারণে বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যাংকগুলোকেও বড় ধরনের ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেয়ার কারণে ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব ঋণ অশ্রেণিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেসব ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারবে। তবে নগদ আদায় ছাড়া এ সুদ আয় খাতে স্থানান্তরে ব্যাংকগুলোকে সম্ভাব্য ঝুঁকি পর্যালোচনাসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা পরিপালনের কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি বছর জুনের ঋণের কিস্তির ন্যূনতম ২০ শতাংশ ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ বছর ৩১ আগস্টের মধ্যে পরিশোধ করলে ওই সময়ে ঋণ বিরূপ মানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।

এ বিষয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, গত বছর জুনে কভিড-১৯ মহামারির অবস্থা ছিল ভয়াবহ। এবারের পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় তুলনামূলকভাবে ভালো। তাছাড়া এ বছর গ্রাহক টাকা পরিশোধ না করেও নিয়মিত রয়েছেন। কোনো খেলাপি হয়নি। এখানে অনেক সাশ্রয় হয়েছে। তাছাড়া সুদের ইনকামও ভালো হয়েছে এবার।

তিনি আরও বলেন, আমদানি-রপ্তানির প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে আমাদের দেশ। এখানেও ভালো কমিশন এসেছে বলে জানান তিনি।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক মাসরুর আরেফিন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের জন্য বড় বিষয় নয়। এখন সময় হলো সম্পদের গুণগত মান ঠিক রেখে মূলধনের ভিত শক্তিশালী রাখা। ব্যাংক কখনই স্বল্পমেয়াদি কোনো ব্যবসা নয়। গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রেখে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকাই যেকোনো ব্যাংকের বড় সফলতা।

বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সিটি ব্যাংকের ২০২০ সালের পরিচালন মুনাফা থেকে আমরা অতিরিক্ত ১৭০ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছি। চলতি বছরও পরিচালন মুনাফা থেকে ২০০ কোটি টাকা বাড়তি সঞ্চিতি রাখতে চাই। দেশের অন্য ব্যাংকগুলোরও একই পন্থা অনুসরণ করা দরকার।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৯৯ কোটি টাকা। চলতি বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৫০৫ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫০৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৯৯ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা ভালো না থাকলে ব্যাংকের পক্ষে ভালো থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউও চোখ রাঙাচ্ছে। সরকার ঘোষিত লকডাউন দিন দিন কঠোর করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ভালো থাকার সুযোগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি খারাপ হলে তার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংকের ওপর পড়ে। তাই আপতত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন।

আবুল কাশেম মো. শিরিনের ভাষ্য হলো, কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ থেকে ভালো মুনাফা করেছে। আবার আগে কিনে রাখা সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের মুনাফার কারণেও কিছু ব্যাংকের মুনাফার চিত্র ভালো দেখাচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৪৮৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংক এশিয়া। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৪৭২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৩৪৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফায় ছিল। চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফায় ৪৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। এ সময়ে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ২৪৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক।

ইসলামী ধারার এক্সিম ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩৪৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছর একই সময়ে ২৩৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। এছাড়া চলতি বছরের প্রথমার্ধে এনসিসি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১৫ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ২৭৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল।

২০২০ সালের প্রথমার্ধে ২৬৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করা ঢাকা ব্যাংক এ বছর ৩১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে।

আরেক ব্যাংকার বলেন, করোনার আঘাতের পর আমরা ব্যাংকের অপ্রয়োজনীয় পরিচালন ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে এনেছি। পাশাপাশি ব্যাংকের কস্ট অব ডিপোজিটও কমেছে। চলতি বছরের প্রথামার্ধে বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংক বেশ ভালো করেছে। এসব কারণে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফায় ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১৮৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে তা ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৩১০ কোটি, যমুনা ব্যাংক ২৮৫ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ২২৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে চলতি বছরের প্রথমার্ধে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ২৮০ কোটি টাকা।

ছলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও। এনআরবিসি ব্যাংক ১৫০ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ১২৭ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি) ৮০ কোটি ও মেঘনা ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।

সোনালীনিউজ/এলএ