হতাশার মাঝেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে রেকর্ড

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২১, ০৪:০০ পিএম

ঢাকা : করোনা মহামারির কারণে গত প্রায় দেড় বছর ধরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত হতাশার মাঝেও আশার কথা হলো এই সময়ে দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মানুষের সঞ্চয়ী হিসাব খোলার মধ্যদিয়ে বিপুল পরিমাণ আমানতের অর্থ জমা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে (২০১৭৯.২ কোটি টাকা)। করোনার আগের বছর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ ছিল মাত্র সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি (৭৫৪৩.৬ কোটি টাকা)।

অর্থাৎ দেড় বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি (১২৬৩৫.৬ কোটি টাকা)। এরমধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে কয়েক দফা লকডাউন সত্ত্বেও আমানত বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৪৪৯২.১ কোটি টাকা)। যা বর্তমানে ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন এজেন্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, চলতি বছর আবারো লকডাউনের কবলে না পড়লে এজেন্ট ব্যাংকিং দেশে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছবে।

করোনাকালীন লকডাউনের কারণে ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সচল ছিল এজেন্ট ব্যাংকিং। একারণে এই ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান আরো বলছে, ২০২১ সালে মাত্র ৬ মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) মোট লেনদেনের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ৯৪৭.৫ কোটি টাকা (গ্রামাঞ্চলে-১৬৫১৬৯.৩ কোটি এবং শহরাঞ্চলে হয়- ৪৬৭৭৮.২ কোটি টাকা)। যেখানে করোনা শুরুর আগের বছর অর্থাৎ, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫৮.৩ কোটি টাকা (গ্রামাঞ্চলে-৯১৮২৪.৯ কোটি টাকা এবং শহরাঞ্চলে- ৫৫৬৩৩.৪ কোটি টাকা)।

এছাড়া, ২০২০ সালের লেনদেনের পরিমাণ ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৬২.৯ কোটি টাকা (গ্রামাঞ্চলে-২২১৯০৯.৪৮ কোটি এবং শহরাঞ্চলে- ৭১০৫৩.৪১ কোটি টাকা) এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাংক কর্মকর্তা এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে এর ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তারা সঞ্চয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে। নিজেদের ভবিষ্যতের সুরক্ষায় তাদের অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব এজেন্ট ব্যাংকিং আহসান উল আলম বলেন, ‘করোনা চলে গেলে এজেন্ট ব্যাংকিং আরো দ্রুতগতিতে বাড়বে। এটা আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য বটবৃক্ষ হয়ে আসতেছে। একসময় ব্যাংকগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিল বড় বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু আমরা এখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

এদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা, করোনার কারণে বড় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণের কিস্তি প্রদানে ছাড় দেওয়া, খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে অর্থপাচারসহ নানা কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক ধরনের আস্থার ঘাটতি দেখা দেওয়ায় ব্যাংকগুলোও ঝুঁকছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর। ভিক্ষুক থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের মানুষকে গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুন) ব্যাংকগুলো থেকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ৩৭৯.৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। যার মধ্যে শুধু গ্রামাঞ্চলেই বিতরণ হয় ৮৩৫.৯ কোটি এবং শহরাঞ্চলে- ৫৪৩.৬ কোটি টাকা। যেখানে ২০২০ সালে পুরো বছরে বিতরণ হয় ১ হাজার ৫৪৬.৩ কোটি টাকা (গ্রামাঞ্চলে- ৮৬৪.২ কোটি এবং শহরাঞ্চলে- ৬৮২.১ কোটি টাকা)।  

অন্যদিকে, করোনার শুরুর আগের বছর (২০১৯ সালে) ১২ মাসে মাত্র ২৮০. ৪৩ কোটি টাকা (গ্রামাঞ্চলে- ২২৩.৭ কোটি এবং শহরাঞ্চলে-৫৬.৭৩ কোটি টাকা) ঋণ বিতরণ হয়েছিল।

আহসান উল আলম বলেন, ‘আমরা কাজ করছি ভিক্ষুক থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষকে নিয়ে কাজ করছি। তারাই এখন আমাদের মূল টার্গেট। আমি অনেক ভিক্ষুকের অ্যাকাউন্ট করিয়েছি একেবারে প্রফেশনালি।’

প্রথাগত কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেন। যার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের দোড়গোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া,  নতুন উদ্যোক্ত তৈরি করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

ড. আতিউর রহমান জানান, ব্যাংকগুলোকে একটি ব্রাঞ্চ খুলতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা দিয়ে গ্রামেগঞ্জে সেবা প্রদান করা সম্ভবপর না। তাই ছায়া ব্যাংক হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিং নীতি প্রণীত হয়। ফ্রাঞ্চাইজি হিসেবে গ্রামগঞ্জে এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। এরফলে গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষকে সহজেই ব্যাংকিং সেবা প্রদানের পাশাপাশি যিনি এই এজেন্ট তিনিও উদ্যোক্তা হিসেবে মানুষকে সেবা প্রদান করতে পারছেন।

এর মাধ্যমে নানা ধরনের বিল পেমেন্ট করতে পারছে, এসএমই লোনের আবেদন করতে পারছে, সরকারের বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রণোদনা এবং বিভিন্ন আর্থিক সহায়তাসহ নানা ধরনের সহায়তা এসব এজেন্টদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে অনায়েসেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রবাসীদের টাকা সহজেই স্বজনদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিং মূল ব্যাংকের মতো না হলেও ব্যাংকের মতোই সেবা প্রদান করছে। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশে বিপ্লব এনেছে। এই মহামারিতে দেশের অর্থনীতি এখনো যেভাবে সচল রয়েছে তার অন্যতম কারণ  এজেন্ট ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিং।’

ওয়ার্ল্ড জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর বিষয়টিকে ‘এজেন্ট অব চেইঞ্জ বা পরিবর্তনের এজেন্ট’ হিসেবে বাংলাদেশকে আখ্যা দিয়েছে বলে জানান, ড. আতিউর রহমান। এছাড়া, একটি উন্নয়ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ মানুষ বলেছে, আমি কোনোদিনই ব্যাংকে টাকা রাখতাম না, যদি ব্যাংক আমার পাশে না আসত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৬৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৪০ টি পুরুষ ( গ্রামে- ৪৭৮২৬০০ টি এবং শহরে-১৮১৫৫৪০ টি) এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। এই সময়ে মোট ৫১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪৫ টি নারী (গ্রামে-৪৪১৬৪৭০ টি এবং শহরে- ৭৩৭৮৭৫ টি) অ্যাকাউন্ট  খোলা হয়।

আর ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট পুরুষ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল- ৫২ লাখ ৮২ হাজার ১৯৭  টি ( গ্রামে-৩৭ লাখ ৬৬ হাজার ৩০২  টি এবং শহরে-১৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৯৫ টি)। একইসময়ে মোট নারী অ্যাকাউন্ট সংখ্যা- ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৩৩ টি ( গ্রামে-৩৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৬৪  টি এবং শহরে-৬ লাখ ২০ হাজার ৬৯ টি)

এছাড়া, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আউটলেটের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ হাজার ৯১৪ টি (গ্রামে-৬৫০৫ টি এবং শহরে- ১৪০৯ টি)। যা ২০২০ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯২৯ টিতে (গ্রামে ১০ হাজার ৩৫১ টি এবং শহরে-১ হাজার ৫৭৮ টি)। আর ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এজেন্ট সংখ্যা বেড়ে হয় ১২ হাজার ৯৯৫ টি (১১ হাজার ১৯৬ টি গ্রামে এবং ১ হাজার ৭৯৯ টি শহরে)।

সোনালীনিউজ/এমটিআই