ঢাকা : রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং করোনা মহামারি বিদেশে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে অনেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ার মতো কিছু বিনিয়োগের গন্তব্যস্থলে রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়েছেন কিছু বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী। তাদের মতে, রপ্তানিপণ্য বৈচিত্র্যকরণ এবং বিশ্বের নানা দেশের প্রদত্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে বিদেশে বিনিয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। এতে স্বল্প-আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের সময় দেখা দেওয়া আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকরা দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিদেশে বিনিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালা আরো সহজ করার আহ্বান জানান। এর ফলে উদ্যোক্তারা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশের দেওয়া সুবিধা কাজে লাগিয়ে দূরদর্শী বিনিয়োগের মাধ্যমে শুল্কহীন রপ্তানির সুবিধা পাবেন।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, বিশ্ব বাণিজ্যের সুবিধা পেতে হলে সম্ভাব্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণে ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই ব্যাপক গবেষণা করা উচিত।
২০১৩ সালে প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড মিয়ানমারভিত্তিক একটি প্রেট্রোলিয়াম কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের আওতায় ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রতিবেশী দেশটিতে বিনিয়োগ করে। প্রাথমিকভাবে দেশীয় কোম্পানিটি ভালো মুনাফারও মুখ দেখে।
তবে দেশটির রাজনৈতিক সমস্যা, ব্যবসায়িক নীতি পরিবর্তন ও স্বচ্ছতার অভাবের কারণে কয়েক বছর পরই লোকসানে পরে এমজেএল। বেশ বড় লোকসান দিয়ে ২০২০ সালে ব্যবসা গুটিয়ে ফেরত আসে তারা।
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারপারসন এবং এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, দেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে সঠিক সময়ে আর্থিক বিবরণী প্রকাশ আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের আর্থিক হিসাব বছরের একটি বড় গড়মিল রয়েছে। জান্তানির্ভর হওয়ার কারণে ওদের নীতিমালা ব্যবসাবান্ধব নয়। ওদের মুদ্রা বিনিময় হার খুব বেশি উঠানামা করার কারণে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
তিনি বলেন, মিয়ারনমার থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়ে সিঙ্গাপুরে ব্যবসা শুরুর পর ওখানে ভালো সাড়া পেয়েছি। কোম্পানিকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশের বেশি রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে।
কারখানা স্থাপনে জমির কম মূল্য ও সস্তা শ্রমের উপস্থিতি থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিতে ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলে ২০১৮ সালে একটি গার্মেন্টস কারখানা চালু করে ডিবিএল গ্রুপ। এই কারখানার আর্থিক সমর্থনদাতা ছিল ইথিওপিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সুইডিশ ফ্যাশন ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম।
দেশটিতে শুরু হওয়া গৃহবিববাদের কারণে ২০২০ সালে কারখানা বন্ধ করে বিশেষ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের দেশে ফিনিয়ে আনে প্রতিষ্ঠানটি। গৃহযুদ্ধ শেষ না হওয়ায় কারখানার পুনরায় চালু হওয়ার বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যে দেশে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার আগ্রহ রয়েছে-সেখানে সহজে ব্যবসা করার সুবিধা, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, বাজার প্রবেশ সুবিধা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো বিষয়গুলো গভীর বিশ্লেষণ করে তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বহির্মুখী বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের একটি আলাদা বিভাগ চালু করাসহ বিদেশে বিনিয়োগের পরিপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। বর্তমানে কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া এধরনের বিনিয়োগকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি কমিটি দ্বারা কেস-টু-কেস ভিত্তিতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রহমান বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতীয় মডেল অনুকরণ করতে পারে।
মেঘনা গ্রুপের অপারেশন্স ডিরেক্টর লুৎফুল বারী বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের উচিত বিদেশে বিনিয়োগকে প্রস্তুতির অংশ হিসাবে রাখা। না হয় শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশের সুবিধা ছাড়া কিছু খাত তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, জর্ডান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে মার্কিন বাজারের জন্য কিছু উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদনের জন্য আমরা কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দোকানগুলো খুলে যাওয়ায় জর্ডানে তাদের মহামারি-প্রভাবিত কারখানা এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
সার্ভিসইঞ্জিনবিপিও বা সেবপো নামের একটি সংস্থা বিশ্বের বৃহৎ সব বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় আউটসোর্সিং পার্টনার। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিনির্ভর হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও মহামারির মন্দা পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পর আরো চাঙ্গা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন গ্রুপের অঙ্গঃপ্রতিষ্ঠান সেবপো।
আবদুল মোনেম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, এখন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে ক্লায়েন্ট বেজ বাড়াতে বিনিয়োগ করছে সেবপো।
দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংগঠন আকিজ গ্রুপ, রবিন রিসোর্সেস নামে একটি মালয়েশিয়ার কোম্পানিকে ২ কোটি ডলারে অধিগ্রহণ করেছে। কোম্পানিটি এ বিনিয়োগ থেকে ভালো রিটার্ন পেয়েছে। আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস কে বশিরউদ্দিন বলেন, তারা একটি পুরনো কোম্পানি অধিগ্রহণ করায় ব্যবসা পরিচালনায় নতুন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। ইক্যুইটি বিনিয়োগে রিটার্ন সন্তোষজনক। বর্তমানে, পাঁচ শতাধিকের বেশি লোক এতে কাজ করছে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে বিদেশে বিনিয়োগ করে দেশীয় ওষুধের সবচেয়ে বড় জায়ান্ট স্কয়ার। ২০১৭ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কারখানা স্থাপন শুরু করে কোম্পানিটি। এক বছর আগেরই সব অবকাঠামো শেষ করেছে তারা। তবে করোনার কারণে উৎপাদন আটকে গেছে তাদেরও।
একই ভাবে আমেরিকার বিশাল ওষুধের বাজার ধরার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ৪০২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের এসিআই গ্রুপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) শর্ত মেনে অটোমেটেড কারখানা স্থাপনের কাজ দুই বছর আগে শেষ করে তারা। তবে এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
কেনিয়ায় ইস্পাতখাতে বিনিয়োগের জন্য বিএসআরএমকে ২০১৬ অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটিকে শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) থেকে ৪৬ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিনিয়োগের টাকায় যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কেনিয়া ইস্ট আফ্রিকা স্টিল লিমিটেডের শেয়ার কিনে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল বিএসআরএমের। আফ্রিকার বাজার ধরতে প্রাথমিকভাবে বছরে ৫ লাখ টন এমএস রড উৎপাদনের লক্ষ্যও নির্ধারণ করে। তবে অনুমোদনের ৫ বছর পরও কারখানা স্থাপন শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এনিয়ে গ্রুপ সিএফও এবং বিএসআরএম কোম্পানি সেক্রেটারি প্রকাশ রঞ্জন কর বলেন, দেশটিতে জমি কিনতেই বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ওই দেশের নিয়মকানুনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সব কাজ সমাধান করা বেশ কঠিন।
দেশের ফার্মাসিটিক্যাল খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড শ্রীলংকায় বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা শেষে অনুমোদন পেলেও প্রতিষ্ঠানটি শ্রীলংকায় বিনিয়োগের সুযোগ হারায়। কারণ ততদিনে দেশটি এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দেয়। সমপ্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর বেসকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ক্ষোভের সঙ্গে এ তথ্য জানান।
এর আগে ২০১৪ সালে দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি পায় ওষুধ খাতের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিকভাবে এস্তোনিয়াতে একটি যৌথ বিনিয়োগকারী কোম্পানি গঠনের কথা ছিল। তবে বাংলাদেশ সরকারের কঠিন শর্তারোপের কারণে এখনো তা কাগুজে অনুমোদনেই রয়েছে। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদীর বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০-২২টি শর্ত দিয়েছে। এসব শর্ত মেনে বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
সোনালীনিউজ/এমটিআই