ঢাকা : দেশে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই থামছে না দামের এই ঊর্ধ্বগতি। চাল, তেলের পর এখন চিনি, আটা, ময়দা, ডাল, ডিম, মুরগি এবং প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বাড়ছে। চালের দাম বৃদ্ধিতে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও আমদানীকৃত পণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নিম্নআয়ের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।
আমদানিনির্ভর পণ্য তেল, চিনি এবং ডালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি, সরবরাহ সংকট এবং পণ্য পরিবহনের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি)-এর উইং প্রধান, অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভোজ্যতেলের ৯৫ শতাংশ, চিনি ৯৮ শতাংশ এবং ডালও প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। এসব পণ্য যেহেতু আমদানিনির্ভর সেকারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি জানান, এই তিনটি পণ্য যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয় সেসব দেশে করোনা ভয়াবহ আকারে হানা দেওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে।
তিনি দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আরো বলেন, ‘আমরা ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে চিনি এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করি। কিন্তু এসব দেশে করোনা ভয়াবহ হানা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব পণ্যের সোর্সিং কান্ট্রিও বেশি না।
অন্যদিকে পরিবহন পণ্য খরচ (ফ্রেইট) বেড়েছে প্রায় ৩৬০ শতাংশ। ফলে দেশে এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হচ্ছে না।’
শফিকুজ্জামানের মতে, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, চিনি এবং মসুর ডালের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশে তেমন বাড়েনি। এ ছাড়া মরিচের দাম বৃদ্ধির পর ভারতীয় বর্ডার খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দাম কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম কমার শিগগির কোন সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম দ্রুত কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তাই সামনের দিকে কোনো ভালো খবর দেওয়ার নেই। এরকম আরো ২ থেকে ৩ মাস চলতে পারে।’
এদিকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, প্রায় এক যুগের মধ্যে মাস হিসেবে মে মাসে হিসেবে সর্বোচ্চ বেড়েছে খাদ্যের দাম।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যে দেখা গেছে, গত এক বছর ধরেই বাড়ছে বিশ্বে খাদ্যের দাম। করোনা মহামারির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। একারণে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রভাব ফেলতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সারা বিশ্বের শস্য, তেলবীজ, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস ও চিনির দরের ওপর ভিত্তি করে খাদ্য মূল্যসূচক তৈরি করে এফএও। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মে মাসে খাদ্যের দাম ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০১০ সালের অক্টোবরের পর এক মাসে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর খাদ্য মূল্যসূচক এতটা কখনোই বাড়েনি।
তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য ছাড়াও দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের দামও লাগামহীন হয়ে পড়ছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেড়েই চলেছে আটা-ময়দা, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। এছাড়া দাম বৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে আদা ও রসুন। গত এক থেকে দেড় মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
অর্থ্যাৎ, মাস দেড়েক আগের ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। এছাড়া, পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দামও বেড়েছে প্রায় একই হারে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সব জিনিসের দামই কিছু না কিছু বাড়ছেই। গত এক মাস ধরে বাড়ছে ডিমের দামও। এক মাসের ব্যবধানে ডজন প্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ২৫ টাকা।
গত এক মাসে বড় আকৃতি মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকার মতো। এ ছাড়া, প্যাকেট ময়দার দাম ৮ টাকা, প্যাকেট আটার দাম কেজিতে ৬ টাকার মতো বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সবজির দাম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার ওপরে।
ঝিঙের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা, করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং বরবটির কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সবজির সরবরাহ সাধারণত কম থাকায় দাম বাড়তির দিকেই থাকে এই সময়টাতে। তবে ক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, এই বছরের মতো সবজির এমন ঊর্ধ্বমুখী দাম অন্যান্য বছর সচরাচর দেখা যায় না। তাদের অভিযোগ, সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
সোনালীনিউজ/এমটিআই