ঢাকা : ব্যাংক খাতে দিন দিন কমেই চলেছে আমানতের সুদহার। কোনোভাবেই কার্যকর হচ্ছে না মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি রাখার নির্দেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার এখন ঠেকেছে ৪ দশমিক ০১ শতাংশে। অথচ মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত আগস্টে আমানতের গড় সুদহার ছিল সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ। তবে পরের মাসে ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের গড় সুদহার বেড়ে হয় ৪ দশমিক ০৮। কিন্তু অক্টোবরে আবারো কমে যায়। দেশের ইতিহাসে ব্যাংকে আমানতের সুদহার এর চেয়ে কম কখনো ছিল না। ফলে ব্যাংক খাতে আমানতের সুদ হার নিয়ে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।
যদিও মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদহার বেশি রাখতে যে নির্দেশ দেয়া হয়, সেটি শুধু ব্যক্তি আমানতের ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের সুদহার সর্বনিম্ন কত হবে, সে বিষয়ে অবশ্য কিছু বলা নেই। আর ব্যাংকে যে টাকা জমা রাখা হয়, তাতে ব্যক্তি আমানতের অবদান শতকরা হিসাবে অর্ধেকেরও কম।
করোনা শুরুর আগে প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংক আমানতের তীব্র সংকটে ছিল। তখন বেশি সুদের প্রস্তাব দিয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে নিজ দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতায় ছিলেন ব্যাংকাররা। কিন্তু করোনো মহামারির শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারালে ঋণের চাহিদা যায় কমে। বিনিয়োগখরায় দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয় অলস তারল্যের পাহাড়। সে সময় কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার নামায় ২ শতাংশের নিচে।
এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগী হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার দিয়ে জানানো হয়, মেয়াদি আমানতে সুদহার আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম থাকা চলবে না। কিন্তু এই সার্কুলারের সঙ্গে ব্যাংকের সুদহারের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত জুলাই মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৩৬ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে হয় ৫.৫৪ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে হয় ৫.৫৯ শতাংশ। অক্টোবরে তা বেড়েছে আরো।
অন্যদিকে গত মে মাসে আমানতের গড় সুদ ছিল ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে, জুলাইয়ে যা আরও কমে হয় ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। পরের দুই মাসেও ধারাবাহিকভাবে কমে আরও। সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম থাকায় ব্যাংকে টাকা রেখে গ্রাহকদের কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো টাকার মান কমে যাওয়ায় হচ্ছে লোকসান।
এদিকে, আমানতের সুদহার কমালেও ঋণের সুদহার ঠিকই বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। করোনার সময় যখন ঋণপ্রবাহ তলানিতে ঠেকেছিল, তখন ৭.৯৯ শতাংশ সুদহারে ব্যক্তিগত ঋণ নিতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বার্তা পাঠানো হতো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর আর্থিক কর্মকা্লের গতি বাড়ার পর ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ঋণের সুদহারও।
সবশেষ তথ্য বলছে, ঋণের গড় সুদহার এখন ৭.১৫ শতাংশ, যা গত বছর এই সময়ে ছিল ৭.৬৭ শতাংশ। গত আগস্টে তা ছিল ৭.২৪ শতাংশ, জুলাইয়ে ছিল ৭.৩০ শতাংশ। গতবছরের এপ্রিল মাসে আমানত-ঋণের সুদ হার নিদির্ষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ঠিক হয় ক্রেডিট কার্ড ছাড়া যেকোনো ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ, আর আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি রাখার আদেশ না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন বলেন, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করলে সুদহার বেড়ে যেত। কিন্তু এক লাখ টাকা দেখা যাচ্ছে ডিপোজিট না করে সেভিংস অ্যকাউন্টে রাখা হচ্ছে। টাকা ব্যাংকে না রেখে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে।
তিনি বলেন, ফিক্সড ডিপোজিটে মানুষ টাকা না রেখে টাকা শেয়ারবাজারে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির সমান সুদ ফিক্সড ডিপোজিটে দেয়ার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণে কারেন্ট ও সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্টের কোনো নির্ধারিত মাত্রা বলে দেয়া নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ অমান্য করে মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হারে সুদ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন আমানতে সুদহার বাড়া শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে এটা বেড়ে যাবে এমন নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ব্যাংকাররা মেনে চলছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, কয়েকটি ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার এখন আড়াই শতাংশের কম। মূল্যস্ফীতির হার এর চেয়ে অনেক বেশি।
জানা গেছে, অক্টোবর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের গড় সুদ হার ৪.০৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সুদ হার সোনালী ব্যাংকে, ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে এই সুদহার ছিল ৩.৩৫ শতাংশ। আর বিশেষায়িত কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ও প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের গড় সুদ হার ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গড় সুদ হার ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সুদহার ছিল ডাচ্-বাংলায়, ১.৭২ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে এই ব্যাংকটির গড় সুদহার ছিল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। আগস্টে এই ব্যাংকটির গড় সুদহার ছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
অক্টোবরে ব্র্যাংক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ২.৩০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ। আগস্টে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ১১ শতাংশ।
প্রাইম ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ছিল ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে আমানতের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে গত অক্টোবরে আমানতের গড় সুদহার বেড়ে ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির সুদহার ছিল ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগস্টে আমানতের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ইস্টার্ন ব্যাংকে গত অক্টোবরে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৩ দশমিক ০৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ছিল ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগস্টে আমানতের গড় সুদ ছিল ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ ছাড়া সিটি ব্যাংকের গড় সুদ ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তবে এত কিছুর পরও ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়ে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এর আগের বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
সোনালীনিউজ/এমটিআই