ঢাকা : দেশে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবার (এমএফএস) জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। করোনা মহামারির কারণে কয়েক বছরে এমএফএসের গ্রাহক সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ১১ কোটিরও বেশি গ্রাহক রয়েছে এমএফএস সেবার। গত ডিসেম্বরে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এমএফএসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ঘরে বসে হিসাব খুলতে লাগে না কোনো খরচ। শহর কিংবা গ্রাম যেকোনো মুহূর্তেই লেনদেন। রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তোলার সুযোগ।
এছাড়া বিভিন্ন পরিষেবা যেমন- কেনাকাটার বিল, বেতন কিংবা টিউশন ফি পরিশোধ, মোবাইল ফোনের রিচার্জ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে টাকা পাঠানো সবই হচ্ছে মোবাইল ফোনে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেনের আগ্রহ বেড়েছে। মানুষ এখন ভিড় এড়াতে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো এমএফএস প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখছে। যাদের হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে, তাদের অধিকাংশেরই মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় করপোরেট বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি শিল্পমালিকরাও মোবাইল ফোনে লেনদেন করছেন।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩টি এমএফএস সেবার হালনাগাদ তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ এখন মোবাইল ফোনে বেশি লেনদেন করছেন। বাড়ছে এজেন্ট ও গ্রাহকের সংখ্যাও। এর বাইরে ডাক বিভাগের সেবা নগদেও নতুন নতুন গ্রাহক ও লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৯-এ। এর মধ্যে গ্রামে ছয় কোটি ২৩ লাখ এবং শহরের গ্রাহক সংখ্যা চার কোটি ৯২ লাখ। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ছয় কোটি ৩০ লাখ এবং মহিলা গ্রাহক প্রায় পাঁচ কোটি। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৮ জনে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে এমএফএস সেবায় এক কোটি ২১ লাখ ৬২ হাজার গ্রাহক বেড়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা ছিল নয় কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার। একই সময়ে বেড়েছে ৬৪ হাজার ৫৬১ এজেন্ট।
মোবাইল ব্যাংকিং এখন শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়। এর মাধ্যমে পরিষেবা বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা গ্রহণ, টিকিট ক্রয়, স্কুলের বেতন ও বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ এবং সরকারি অনুদানও প্রদান করা যাচ্ছে।
গত ডিসেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে ৭১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। যা একক মাস হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। এর আগে সর্বোচ্চ লেনদেন হয় গত বছরের (২০২১ সাল) মে মাসে। ওই মাসে ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়
এ মাধ্যমে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টের কাছে যেতে হয় না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এ হিসাবে। আবার এ হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা দেওয়া যাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেওয়া যাচ্ছে। ফলে একটি মোবাইল ফোন একেকজনের কাছে একটি ব্যাংক হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হলো ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’। এমএফএসের লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, কয়েকটি কারণে এমএফএস সেবার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিকাশের মতো প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসেই মোবাইলে সবধরনের লেনদেন করতে পারছে।
শুধু লেনদেনেই সীমাবদ্ধ নয়, বিভিন্ন পরিষেবা যেমন- কেনাকাটার বিল, বেতন কিংবা টিউশন ফিও পরিশোধ করা যাচ্ছে এ মাধ্যমে। এছাড়া, গ্রাহক এখন শাখায় না গিয়ে ব্যাংক হিসাব থেকে লেনদেন করতে পারছে। ব্যাংক ঋণ এমনকি আমানতের অর্থও মোবাইলে পরিশোধ করতে পারছে।
শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, করোনার এ মহামারির সময় গ্রাহক ব্যাংকের শাখায় না গিয়ে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন বেশি নিরাপদ মনে করছে। এছাড়া কোভিডের ক্যাশলেস লেনদেনের বিষয়ে অনেকে পরিচিত হয়েছেন। ফলে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকছেন। লেনদেনও বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রেকর্ড পরিমাণ লেনদেন হয়েছে। লেনদেনের পরিমাণ সাত লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের চেয়ে ৩৭ শতাংশ, দুই লাখ আট হাজার ৭৭০ কোটি টাকা বেশি। গত বছর লেনদেন হয়েছিল পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
তবে এখানে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’-এর তথ্য সংযুক্ত হয়নি। ২০২১ সালে নগদে দুই লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সে হিসাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ২০২১ সালে মোট লেনদেন হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। নগদসহ এ সেবায় নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৫৪ লাখে।
এ বিষয়ে নগদের হেড অব কমিউনিকেশন্স মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, দৈনন্দিন লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যবহার সুবিধার জন্য মানুষ ধীরে ধীরে মোবাইল আর্থিক সেবার ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন এখন ডিজিটাল জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এখন ডিজিটাল স্পেসে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া, কোভিড মহামারি নিশ্চিতভাবে গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
দেশের অন্যতম মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস হিসেবে নগদ এ খাতে বড় অবদান রাখছে। শুধুমাত্র ২০২১ সালে নগদ তিন কোটি ৪০ লাখ নতুন গ্রাহক পেয়েছে। এটি ডিজিটাল পেমেন্ট খাতকে আরো বেশি এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, নগদের আকর্ষণীয় সেবা ও অফার গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে লেনদেনে আগ্রহ বাড়িয়েছে। আমরা নিশ্চিত যে, নগদের এ নিরন্তন প্রচেষ্টা দেশে ক্যাশলেস (নগদবিহীন) সোসাইটি (সমাজ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি উন্নত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে ৭১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। যা একক মাস হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। এর আগে সর্বোচ্চ লেনদেন হয় গত বছরের (২০২১ সাল) মে মাসে। ওই মাসে ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
ডিসেম্বর মাসে এমএফএস সেবায় ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে ২০ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ বিতরণ হয় দুই হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন পরিষেবার এক হাজার ১৫৮ কোটি টাকার বিল পরিশোধ হয়। কেনাকাটার তিন হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার বিলও পরিশোধ হয় এ মাধ্যমে।
২০১১ সালের মার্চে দেশে প্রথম মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবার কার্যক্রম শুরু হয়। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এ সেবা চালু করে। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘রকেট’। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। বর্তমানে এ সেবার সিংহভাগই বিকাশের দখলে।
ডাক বিভাগের ব্র্যান্ড ব্যবহার করে ‘নগদ’ বাজারে লেনদেন শুরু করে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। বর্তমানে বিকাশ, নগদ, রকেটের পাশাপাশি এম ক্যাশ, উপায়, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই