ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে হয়। এখন দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
তার পরও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এখন চাল, সবজি ও মাছ রফতানিকারক দেশ। ২২ ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে।
এর মধ্যে চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ, চায়ের মতো পণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফল। গত এক দশকে কুমড়া, ফুলকপি ও সমজাতীয় সবজির মতো কিছু পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেশভিত্তিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে চিত্রটি দেখা যায়। সংস্থাটি গত মার্চে এই পরিসংখ্যান হালনাগাদ করে। এতে তথ্য দেওয়া হয় ২০২১ সালের।
এফএওর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য ছিল ৩ হাজার ৬১১ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার লাখ কোটি টাকার সমান। উৎপাদনের পরিমাণ ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন।
এফএওর হিসাবে, ২০০১ সালে ১১টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ দশে ছিল বাংলাদেশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭টিতে। এরপর বিভিন্ন বছরে যোগ হয় আরও পাঁচটি কৃষিপণ্য-পেঁয়াজ, কুমড়া, ফুলকপি ও ব্রকলি (ফুলকপির মতো সবজি), পাখির খাদ্য (বীজ) এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত শিমের বিচি। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ২২টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।
এফএও মোট ১৬২টি প্রাথমিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের হিসাব দিয়েছে। বাংলাদেশ ৬৮ ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনের তালিকায় রয়েছে। এ তালিকায় যেমন একক পণ্য আছে, তেমনি সমজাতীয় ও মৌসুমভিত্তিক কয়েকটি পণ্য মিলিয়ে একটি শ্রেণি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ কোনো পণ্য উৎপাদনে প্রথম নয়। তবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে। চাল, রসুন এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত চিনিজাতীয় ফসলে (যেমন জোয়ার) বাংলাদেশ তৃতীয়। জাম, বরই, করমচা, লটকন ইত্যাদি বেরিজাতীয় ফল এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত সুগন্ধি মসলায় চতুর্থ। মসুর ডাল ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল (কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি) উৎপাদনে বাংলাদেশ ষষ্ঠ। সপ্তম অবস্থানে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারকেলের ছোবড়া উৎপাদনে। চা ও কুমড়ায় বাংলাদেশ অষ্টম। আম, পেয়ারা ও গাবজাতীয় ফল, ফুলকপি ও ব্রকলি এবং মটরশুঁটি ও পাখির খাদ্য (বীজ) শ্রেণিতে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
প্রধান কিছু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। যেমন আলু। দুই দশক আগে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল ২০তম দেশ। এরপর কানাডা, তুরস্ক, পোল্যান্ডের মতো ১৩টি দেশকে একে একে পেছনে ফেলে ৭ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এফএওর তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে ৯৮ লাখ টন।
মরিচ (শুকনা) উৎপাদনে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এক দশকে চীন ও থাইল্যান্ডকে পেছনে ফেলে মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠেছে বাংলাদেশ।
চাল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। চার দশকের বেশি সময় ধরে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ অবস্থানে। ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় অবস্থানে ওঠে বাংলাদেশ। শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত।
স্বাধীনতার পর মসুর ডালের উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশে ছিল। পরে বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়। অবশ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইথিওপিয়া, রাশিয়া ও চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে উঠেছে।
উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় কমেছে। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মসলাজাতীয় এই পণ্যের উৎপাদন ২৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে, যা ছয় অর্থবছর আগের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি। পেঁয়াজ ও সমজাতীয় পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০১৮ সালে দেশে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। তবে উৎপাদন বাড়তে থাকায় আমদানি কমেছে। এখন বছরে সাত লাখ টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি হয়।
পেঁয়াজ আমদানি কমায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। বিপরীতে সয়াবিন বীজ, আখ ও তুলার মতো পণ্য উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানিতে বিপুল ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতেই বাংলাদেশকে ৪১৭ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৪৪৪ কোটি ডলার। ডলার-সংকটের কারণে এখন কিছু পণ্যের আমদানি ব্যাহতও হচ্ছে।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে প্রায় ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। সবজি, শুকনা খাবার, মসলা, সুগন্ধি চাল ইত্যাদি কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১১৬ কোটি ডলারের বেশি।
সোনালীনিউজ/এআর