ঢাকা: করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ধুঁকতে থাকা স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য শূন্য সুদে ঋণ সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মরক্কোর পর্যটন শহর মারাকেশে চলমান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত এসেছে। গতকাল বৈঠকের ষষ্ঠ দিনে পোভারটি রিডাকশন অ্যান্ড গ্রোথ ট্রাস্ট (পিআরজিটি) তহবিল গঠনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার পর এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জেয়িভা এ ঘোষণা দেন। এদিকে আজ শেষ হচ্ছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সপ্তাহব্যাপী বার্ষিক বৈঠক। গত ৯ অক্টোবর মরক্কোর মারাকেশে এ বৈঠক শুরু হয়। ৫০ বছর পর আফ্রিকার কোনো দেশে এমন বৈঠক হচ্ছে।
অন্যদিকে বৈঠকের ৫ম দিনে বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইসহ চারটি অগ্রাধিকারনীতি ঘোষণা করে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ। অন্য নীতিগুলো হচ্ছে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, রাজস্ব আদায় ও মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এ নীতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিবৃতিতে ক্রিস্টালিনা জর্জেয়িভা বলেন, নিম্ন আয়ের দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক বৈশ্বিক ধাক্কায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা শুধু মহামারী থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির ধাক্কাই বহন করছে না, উচ্চ খাদ্যমূল্যের ধাক্কা, উচ্চসুদে ঋণ এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান ঘটনায়ও বিপর্যস্ত। এ সমস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে আইএমএফ নিম্নআয়ের দেশগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী অংশীদার হয়েছে।
তিনি বলেন, মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে পিআরজিটি তহবিলের মাধ্যমে শূন্য সুদে ঋণ পাঁচগুণ বেড়েছে। প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ৫৬টি দেশ উপকৃত হয়েছে। বর্তমানে ৩০টি দেশে পিআরজিটি কর্মসূচি রয়েছে, যা ২০০৯ সালে পিআরজিটি তহবিলের সূচনার পর থেকে সর্বাধিক। পিআরজিটি তহবিল সহায়তার চাহিদা ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা আগের গড়ের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
বিবৃতিতে জর্জেয়িভা বলেন, আইএমএফ বিভিন্ন উপায়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে। মহামারীর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, আমরা অভূতপূর্ব গতিতে আমাদের জরুরি অর্থায়ন বাড়িয়েছি, আমাদের সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের একটি ‘লাইফলাইন’ প্রদান করেছি। আজ পিআরজিটি তহবিল গঠনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ায় এটি নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে একাধিক ধাক্কার অর্থনৈতিক পতন এবং রূপান্তরমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে। আমরা শূন্য সুদে ঋণ সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যও পূরণ করেছি। আমি এই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জনে সদস্যদের অটল প্রতিশ্রুতির জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই।
তিনি বলেন, ৪০টি দেশ এই তহবিল গঠনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করেছে। এই বিস্তৃত সমর্থন প্রমাণ করে যে, আমরা আমাদের সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের সাহায্য করার জন্য একত্রিত হতে পারি।
আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, আইএমএফ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, পিআরজিটি নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে শক্তিশালী সমর্থন প্রদান অব্যাহত রাখবে। তহবিল সংগ্রহের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টি সম্পন্ন করার পর আমরা এখন তহবিলের রেয়াত সুবিধা এবং অর্থায়নের বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা শুরু করব।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পক্ষ থেকে আগামী দিনগুলোতে প্রথম অগ্রাধিকারনীতির মধ্যে মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, এটি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পূর্বশর্ত। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমাজের সাধারণ মানুষকে দরিদ্র হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। তবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমলেও এখনো অনেক দেশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ওপরে বিরাজ করছে। ফলে সুদের হার আরও বেশি দিন ধরে রাখতে হবে। এতে নানা ধরনের আঘাত আসতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে, সেক্ষেত্রে জয়ী হতে হবে।
‘বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে’
বৈঠকের ষষ্ঠ দিনে আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি মনে করি কর্মসূচির উদ্দেশ্য পূরণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং কঠিন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফের বার্ষিক সভা উপলক্ষে ‘ইকোনমিক আউটলুক ফর এশিয়া প্যাসিফিক’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বলেন, বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি কঠোর করেছে এবং নমনীয় বিনিময় হারের অনুমতি দিয়েছে। উন্নয়ন ও অবকাঠামো উভয় ক্ষেত্রে লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সহযোগিতা করার জন্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রতিটি দেশের প্রবৃদ্ধিবর্ধক সংস্কার এগিয়ে নিতে অবশ্যই তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে।
এমএস