ঢাকা : এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধ ব্যাপক হারে বেড়েছে। পর্যাপ্ত আয় না থাকার কারণে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চাপে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণ শোধের চাপও বাড়তে শুরু করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে সরকার এসব ঋণ পরিশোধ করছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেপ্টেম্বরে সেই ঋণ পরিশোধের পরও অতিরিক্ত আরও ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিক খাতে নানা চাপের কারণে মানুষ সঞ্চয়পত্র থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচন নীতির কারণেও পূরনো ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে।
সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে ২১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ফলে সঞ্চয়পত্রে সরকারকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে। একই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ব্যাংক খাতেও।
[210466]
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের ঋণ পরিশোধ করেছে ৩২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এজন্য আলোচিত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৩১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার ঋণ নিতে হয়েছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরও সরকারকে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৪৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমছে। তবে সরকারকে দেওয়া ঋণে তহবিল ব্যয় কম এবং কোনো ঝুঁকি নেই। এখন মুনাফাও বেশি। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও সরকারকে সাধ্যমতো ঋণ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ করে হলেও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল অক্টোবর মাসে ব্যাংকগুলো শুধু আন্তঃব্যাংক রেপো থেকেই ঋণ নিয়েছে ৪৩ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। আর সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ১৮ কোটি টাকা।
এর বাইরেও যেসব ব্যাংকের তারল্য সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে সেসব ব্যাংক বেশি সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করেছে ২৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। যদিও এসব ধার থেকে সরকারকেও ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে রেপো রেটের চেয়ে সরকারের বিল-বন্ডে সুদের হার বেশি। কভিডের আগে এমন পরিস্থিতি ছিল না। সে সময়ে রেপো রেটের চেয়ে বিল-বন্ডের সুদের হার কম ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য বিল-বন্ড কেনার বিকল্প নেই। কারণ কোনো ব্যাংকের যদি আন্তঃব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করতে হয় তাহলে তাকে সহ-জামানত হিসেবে বিল-বন্ড রাখতে হয়। এ ছাড়া ব্যাংকের এসএলআর রাখার ক্ষেত্রেও বিল-বন্ড ব্যবহার করতে হয়।
[210462]
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আর একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বর্তমানে ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণ ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি বছরের জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৬৬৮ কোটি বা ৭৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ যতটা বাড়ছে, তারচেয়ে বেশি বাড়ছে সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকার বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ৮৭ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৭৬ শতাংশ। আর আসল পরিশোধ বেড়েছে ২১ শতাংশ। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই