শিল্পকারখানার বর্জ্যে কমছে কৃষির উৎপাদন

  • গাজীপুর (ঢাকা) প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪, ০২:৩৮ পিএম
সংগৃহীত ছবি

গাজীপুর: দেশের কাঁঠাল ও মাছ উৎপাদনে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী জেলা গাজীপুর। এ জেলায় শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে কৃষি ফসল ও কৃষি পণ্য চাষাবাদেও ভালো নাম ডাক ছিলো। সময়ের পরিবর্তনে জেলার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে গার্মেন্টস, ডাইং কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠায় দিন-দিন ফসলের আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি যেসব জমিতে চাষাবাদ চলমান রয়েছে। সেগুলো জমিতে কৃষি ফসল ও কৃষি জাত পণ্য উৎপাদন নিম্নমুখী হচ্ছে।

বিশেষ করে জেলার কৃষকরা এক ধরনের অভিযোগ তুলেছেন জেলার যেসব এলাকায় গার্মেন্টস কারখানা, ডাইং কারখানা আছে সেগুলোর বিরুদ্ধে। ওই সব এলাকার মধ্যে থাকা আবাদি জমিতে সংশ্লিষ্ট কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও ডাইং কেমিক্যালের কালা রিং দুষিত পানিতে জমির ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। আবারও কিছু এলাকা রয়েছে ডাইং কারখানার কেমিক্যাল মেশানো দুষিত পানি আবাদি জমিতে আসায়। ওই সব জমিতে আর ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে এ শিল্পাঞ্চলের কৃষকরা গভীর দুশ্চিন্তা ও হাতায় ভুগছেন।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন সুত্রে জানা গেছে, শুধু তুরাগ নদের টঙ্গী থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার অংশে ২২৪টি এবং চিলাইয়ে পানিদূষণের ৪৫টি উৎস চিহ্নিত করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে পাগাড়, আরিচপুর, মাছিমপুর, টঙ্গী বাজার, কামারপাড়া, রুস্তমপুর, ইছরকান্দি, কাশিমপুর, কড্ডা, মির্জাপুর, বোয়ালী, মকশ বিল, কালিয়াকৈর বাজার, দেশীপাড়া ও জয়দেবপুর এলাকায়।

গাজীপুরের ভুক্তভোগী কৃষকরা জানিয়েছেন, অনেক সময় পার হয়ে গেছে এখনো যদি সরকার ও কারখানার মালিকরা শিল্পের বর্জ্য ও দুষিত পানি আবাদি জমিতে পড়া বন্ধ করার কোন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে গাজীপুরের আবাদি জমি কৃষি ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

জেলার কালিয়াকৈরের ঐতিহ্যবাহী মকশ বিলের কোলঘেঁষা গ্রাম তালতলী। সেখানকার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী অতুল সন্ন্যাসী। একসময় নিজের পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে ফসল চাষ করে সারা বছর খেতেন তিনি। এখন আর সেসব জমি চাষের জন্য উপযোগী নেই। তার যতটুকু জমি রয়েছে অধিকাংশই কারখানার বর্জ্য ও ডাইং কেমিক্যালের দূষিত পানি জমিতে এসে জমির কৃষি পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।

অতুল সন্ন্যাসী আরও বলেন, বাড়ির আশপাশের প্রায় সব জমি আমার। আগে পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে ধানের পাশাপাশি শীতের মৌসুমে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলাসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করতেন, কিন্তু আশপাশের ডায়িং কারখানার ইটিপিবিহীন কেমিক্যাল ও বর্জ্য মেশানো পানি এসে পড়ছে কৃষিজমিতে। এতে করে আর জমিতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। তিনি বলেন, মিলের পচা পানির কারণে কিছু লাগালেও এখন হয় না। বহু আন্দোলন করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সরকারের কর্মকর্তারা মালিকদের পক্ষে কাজ করছে।

গাজীপুরের কড্ডার বাসিন্দা মোতালেব মিয়া বলেন, তুরাগ নদের পানি ১০-১৫ বছর আগেও স্বচ্ছ ছিল। একটা সময়ে এ নদের পানি কৃষিসহ প্রায় সব কাজে ব্যবহার যেতো। এখন শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যে তুরাগ নদের পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোগড়া, বাসন ও কোনাবাড়ী বিসিকসহ আশপাশের ও মৌচাক এলাকায় রয়েছে শত শত শিল্পকারখানা। এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য  ও ডাইং কেমিক্যাল কারখানার দূষিত পানি কোনাবাড়ী জরুনবাইদসহ এর আশেপাশের এলাকার মধ্যে বয়ে চলা খাল-বিল দিয়ে সরাসরি তুরাগ নদে পড়ছে। এ ছাড়া জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাইমাইল ব্রিজের পাশ দিয়ে এসব বিষাক্ত বর্জ্য নামছে তুরাগ নদে।

গাজীপুরের বাইমাইল এলাকার বাসিন্দা কৃষক আফাজ উদ্দিন বলেন, তুরাগ নদের লাগোয়া বিলে তার জমি রয়েছে। সেখানে তিনি এক সময়ে ভালো চাষাবাদ করতেন। এখন তার সেই জমি গুলোতে আশপাশের ডায়িং কারখানার ইটিপিবিহীন কেমিক্যাল ও বর্জ্য মেশানো পানি এসে পড়ছে কৃষিজমিতে। এতে করে দিন দিন নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, পুকুর ও খালের মাছ।

সোনালী নিউজের করা এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানার তরল বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই বাইরে ফেলা হচ্ছে। মুনাফা লোভী ডাইং কেমিক্যাল কারখানার মালিকরা কৃষকদের ক্ষতির কথা না ভেবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব করে যাচ্ছে। যার ফলে সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যা আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে।

গাজীপুর মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল শাহীন জানান, জেলায় ১ হাজার ৭২০ হেক্টর বিল রয়েছে। এছাড়া তুরাগ, বংশাইসহ ১০টি নদ-নদীর ১ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জলাশয়ে প্রতিবছর ২ হাজার ৩২৩ মেট্রিক টন দেশি মাছ উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু গত ১৪ বছরে মাছের উৎপাদন কেবলই কমছে। এর জন্য প্রধানতম দায়ী কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। তিনি আরও বলেন, এভাবে চলতে থাকলে জেলার কৃষক ও কৃষি উৎপাদন একটা সময়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।

এদিকে এসব অভিযোগ ও কৃষকদের উৎকণ্ঠা ও হতাশার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, জেলার দুই হাজারের অধিক পোশাক শিল্প কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে ডাইং কেমিক্যাল কারখানা রয়েছে ৬০০টি। তিনি বলেন, এসব কারখানার কর্তৃপক্ষ ইটিপি নিয়ম নীতি না মেনে বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশিনো পানি বাহিরে ফেলছে। যার ফলে কৃষকের আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যেই অভিযান চালিয়ে নিয়ম না মেনে চলা কারাগার পেলেই জরিমানা করছি। এর পরেও তারা গোপনে অনিয়ম করেন।

ওয়াইএ