ঢাকা: পুঁজিবাজারে বড় দরপতন ঠেকাতে পূর্বে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ফ্লোরপ্রাইস আরোপ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার দোহাই দিয়ে এ ব্যবস্থা নিয়েছিল কমিশন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেলে তড়িঘড়ি করে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে কি ঝুটলো প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রায় দেড় বছর ফ্লোরপ্রাইসের মাধ্যমে মূল্যসূচক তথা দরপতন আটকে রাখা গেলেও তা প্রত্যাহারের কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লোরপ্রাইসের আগের অবস্থানে ফিরে গেল বাজার। এর ফলে কোন সিদ্ধাই যে বাজার স্থিতিশীলে কার্যকর হচ্ছে না তা আবারও প্রমাণ হলো।
[219556]
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকটি ১৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার ৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৬৮ পয়েন্টে নেমে আসে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৫ মে ডিএসইএক্স সূচক এর চেয়েও নিচে ৫ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। ২০২০ সালে মহামারির কারণে লম্বা সময় শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। আর এ বন্ধের মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্ব বদল হয়। অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত বিএসইসি ২০২০ জুনে আবার লেনদেন চালু করে।
২০২১ সালের শেষভাগে এসে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং ডিএসইএক্স সূচকটি ৭ হাজারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়।
[219472]
ফ্লোরপ্রাইস আরোপের সিদ্ধান্ত:
সময়টা ২০২১ সালের শেষভাগে শেয়ারবাজারে কিছুটা গতি ফিরলেও ২০২২ সালের শুরু থেকে বাজার আবার পড়তে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২৮ জুলাইয়ে ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের কিছুটা নিচে নেমে আসে। সেদিন সূচকটির অবস্থান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্ট। ওইদিন বিকালে বিএসইসি বাজারে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোরপ্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। এ কারণে ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর প্রায় ২০ মাস সূচক আর ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামেনি। তবে বাজার স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ, ফ্লোর প্রাইস আরোপের ফলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারই লেনদেন হতো না।
ফ্লোরপ্রাইস আরোপের ফলে বাজারে লেনদেন একেবারেই কমে যায়। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দিনের পর দিন ক্রেতাশূন্য থাকে। লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারহাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
[219407]
অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে যায়। অতি জরুরি প্রয়োজনেও তারা শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিতে পারেননি। অসংখ্য বিনিয়োগকারীকে দুঃসহ এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।
এ অবস্থায় ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহলে। যার ফলে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। এরপর একপর্যায়ে সূচকটি বেড়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে উঠেছিল। যা কমে আবার ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সূচক ৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৬৮ পয়েন্টে নেমেছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বিএসইসির দাবি ছিল, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুঁজিকে সুরক্ষার দেওয়ার লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
[219404]
ধাপে ধাপে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহার:
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় মাসের মাথায় ৩৫টি বাদে সব কোম্পানির ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। পরে আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের উপর থেকে ফ্লোর তুলে নেওয়া হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে টানা পতন শুরু হয়। আজ বৃহস্পতিবার টানা ৬ষ্ট দিনের মতো দরপতন হয় বাজারে।
দিনশেষে সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে, যা ফ্লোরপ্রাইস আরোপের দিনের চেয়েও প্রায় ১২ পয়েন্ট কম।
২০২২ সালে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দোহাই দিয়ে ফ্লোরপ্রাইসের মতো বিকৃত ব্যবস্থা নিলেও, এখন বাজার পরিস্থিতি তারচেয়ে খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাদের পাশে নেই কেউ। নেই বাজারে তারল্য বা গতি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ। তাহলে এতো দিনের চেষ্টা কিসে ভর করে নেওয়া হয়েছিল জানা নেই কারো। এদিকে বাজারে ভালো কোম্পারি অভাব গুণতে হচ্ছে দীর্ঘদিন। শত চেষ্টাও যেন ফলদায়ক হয়নি কমিশনের।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সূচক ৬ হাজারের নিচে নামলেও বিনিয়োগকারীদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার। তাদের মতে, সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধি পুঁজিবাজারের অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বাজারে শেয়ারের দাম বেশি কমে গেলে নতুন ক্রেতা তৈরি হয়, নতুন বিনিয়োগকারীও আসে। তারা সক্রিয় হলে শেয়ারের দাম ও সূচক বৃদ্ধি পায়। এভাবে বাজারে এক ধরনের ভারসাম্য আসে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা এবং কোম্পানির ভাল-মন্দ যাচাই করে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
তারা বাজারে বিএসইসির হস্তক্ষপেরও বিপক্ষে।
অতীতে ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, বাজারে বেশি দর পতন হলে ফোন করে ব্রোকারদেরকে শেয়ার বিক্রি করতে বারণ করা অথবা বেশি বেশি করে শেয়ার কিনে বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার মত নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ব্যবস্থা বাজারের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, সূচক কোন দিকে যাচ্ছে তা না দেখে, বাজারে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি-না, আইনের পরিপালন ঠিক আছে কি-না তার দিকে নজর দেওয়া বেশি জরুরী।
সিইও ফোরামের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত:
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দেশের শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরাম। গত ২২ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিইও ফোরামের সদস্যরা। সেদিন বৈঠক শেষে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিইও ফোরামের প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছায়েদুর রহমান। বৈঠকে দেশের ৩০টি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সিইও উপস্থিত ছিলেন।
ছায়েদুর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাপোর্ট অব্যাহত রাখবে সিইও ফোরাম। বিনিয়োগকারীদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করেন। তারা যেন পজিটিভলি চিন্তা করেন। কারণ একদিনের ব্যবধানে পুঁজিবাজারের চিত্র পাল্টে গেছে। বাজার আজকে পজিটভ মুভমেন্টে রয়েছে। যেটাকে ধরে রাখার জন্য সিইও ফোরামের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় তা চেষ্টা করা হচ্ছে।
ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের দিন সিইও ফোরামের সিদ্ধান্ত ছিল, পুঁজিবাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিলার অ্যাকাউন্টে ১ থেকে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। ডিলার অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো শেয়ার বিক্রি করব না। বিনিয়োগকারীদেরকে ইতিবাচকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে। যেসব শেয়ারের ক্রেতা থাকবে না সেখানে বিক্রির আদেশ বসানো হবে না। ট্রেডারদের এ বিষয়ে সতর্কতা আবলম্বন করতে বলা হবে। ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের কারণে যাতে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হন বা বাজারে বিক্রির চাপ তৈরি না করেন সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখা হবে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারে প্রধান সূচকের ৬ হাজার পয়েন্ট একধরনের মনস্তাত্ত্বিক সীমা হয়ে উঠেছে। তাই যখন সূচক ৬ হাজারের কাছাকাছি বা নিচে নেমে আসে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করে। এ কারণে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছে না, উল্টো অনেকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে বসে আছেন।
এদিকে একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এরই মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ফোর্সড সেল শুরু করেছে। ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের দাম যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে যায়, তখন ঋণের টাকা উদ্ধারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করে দেন। এটি শেয়ারবাজারে ফোর্সড সেল হিসেবে পরিচিত।
ঢাকার প্রধান শেয়ারবাজারে দেখা গেছে, লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও মাঝারি মানের কোম্পানিগুলো। তার বিপরীতে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের দরপতন হয়েছে। ডিএসইতে এদিন মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষ পাঁচ কোম্পানি ছিল গোল্ডেন সন, এসএস স্টিল, ফু-ওয়াং সিরামিক, অরিয়ন ইনফিউশন এবং লাভেলো। এর মধ্যে লাভেলো, অরিয়ন ইনফিউশন ও রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স ছাড়া অন্য তিনটি কোম্পানি ২০২৩ সালে ২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজার কিছু বাজে কোম্পানি নির্ভর হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে না। এর বিপরীতে বাজে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। তাই তাঁরা অনেকটাই বাজারবিমুখ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে ডিএসইতে লেনদেন কমে ৫০০ কোটির ঘরে নেমেছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের এক নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘বাজার যেখানে চলে গেছে, তাতে ভালো শেয়ার কিনলেই এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের আগ্রহও হারিয়ে ফেলছি, নতুন বিনিয়োগেরও সাহস হচ্ছে না।’
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘দরপতনে মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। তাতে এসব শেয়ারের দাম এখন অবমূল্যায়িত পর্যায়ে চলে এসেছে। কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করবে। সেটি হলে বাজার দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছি।’
এএইচ/আইএ