ঢাকা: দেশের বীমা খাত অগ্রসরে বড় বাঁধা ‘বীমা দাবি পরিশোধ’ এর সমাধান না খোঁজা। সম্ভাবনাময় এই খাতের ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে সময়মত বীমা দাবি পরিশোধ না করা। একদিকে পাচ্ছেন না প্রাপ্ত টাকা, অন্যদিকে গ্রাহকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অধিকাংশ বীমা কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষের নানামুখি লুটপাটের কারণে সংকটে রয়েছে এই খাত।
দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের বিধবা নারী, রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরের মতো মানুষের বীমা দাবির অর্থ লোপাটে ব্যস্ত অধিকাংশ কোম্পানির কর্মকর্তারা। বছরের পর বছর কষ্টের জমানো টাকা উদ্ধারে কোম্পানির পেছনে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। তবুও মিলছে না পাওনা টাকা। উল্টো কোম্পানির কাছে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা।
[241037]
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা খাতে সবচেয়ে বড় ভীতি টাকা না পাওয়া। কিছু কিছু কোম্পানি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। মানুষের টাকা লুটপাট করে অনেক কোম্পানির মালিক নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। বর্তমান সময়ে অনেক কোম্পানির মালিক কিংবা ব্যবস্থাপকদের চুরি করে অফিস করতে হচ্ছে। গ্রাহকদের নানামুখি চাপে অনেকে নিজেদের অফিসে নিজেরাই প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। এসব সমস্যা থেকে বীমা খাতকে বাঁচাতে বড় ধরণের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। এতো কিছুর পরও নীরব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তাদের কার্যক্রম নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছে নানান ক্ষোভ।
বীমা দাবি পরিশোধে তালবাহানা:
বীমা পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৩ থেকে ৪ বছর পার হলেও গ্রাহকদের টাকা দেয়া হচ্ছে না। আবার ২ থেকে ৩ বছর ঘুরে কেউ টাকা পেলেও চুক্তি ও ঘোষণামত টাকা পাচ্ছেন না। নামকাওয়াস্তে একটি চেক ধরিয়ে দিয়ে দায়সারা হচ্ছে বলেও অভিযোগ বীমা গ্রাহকদের। অনেককে বাধ্য করা হচ্ছে পুনরায় বীমা পলিসি করতে।
[241001]
‘চেক’ প্রথায় দায়সারা:
গ্রাহকদের চাপের মুখে বীমা কোম্পানিগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ পলিসির বিপরীতে ৩ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত তারিখ দিয়ে ব্যাংক চেক প্রদান করলেও কার্যত চেক ডিজঅনার হয়; (কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলে ব্যাংক প্রত্যাখ্যান করে দেয়)। এ অবস্থায় বার বার চেক-এর তারিখ পরিবর্তন করেও টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে অনেক কোম্পানি। এই পরিস্থিতির কারণে গ্রাহকরা এখন ব্যাংক চেক প্রদান থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। মুলত নামকাওয়াস্তে ব্যাংক চেক ধরিয়ে দিয়ে থাকে কোম্পানিগুলো। অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপকরা নিজেদের ‘অপদস্ত’ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চেক দিয়ে গ্রাহকদের শান্ত রাখার অপকৌশলের পথ বেচে নিয়েছে। যদিও কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকতো না। তারপরও লাখ লাখ টাকার চেক বিনিময়ে সময়ক্ষেপণ করতো।
বীমা দাবি পরিশোধে প্রতারণার ধরণ:
বীমা দাবি পরিশোধের বদলে গ্রাহকদের পুনরায় পলিসি করার চাপ সৃষ্টি করা বা বাধ্যতামুলক পুনরায় পলিসি করতে বাধ্য করা। এছাড়াও এফডিআর নামক ভোগান্তিতে জড়ানোর পায়তারা করছে অধিকাংশ কোম্পানি।
অনেকে আবার বীমা দাবির অর্ধেক টাকা পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা দিয়ে পুনরায় বিমা পলিসি করতে বাধ্য করে থাকে। এতে নিজের টাকা না পেয়ে বরং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। এসব কারণে বেশির ভাগ পলিসি তামাদি হয়ে পড়ে। যা বিমা খাতের জন্য ক্যান্সার স্বরুপ। এসব কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে বিমা কোম্পানি টাকা দেয় না ভীতি তৈরি হয়েছে। যার ফলে প্রসার হচ্ছে না এই খাতের।
[240972]
বিভিন্ন কোম্পানির মাঠ কর্মীদের লাভের জন্য গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার ঘটনাও অনেক। গ্রাহক থেকে টাকা নিয়ে অফিসে জমা না দেওয়া। ভুয়া রিসিটে টাকা গ্রহন। সঠিক নিয়মে পলিসি না করে কমিশন নামক ক্যান্সারের প্রসার। কোম্পানিগুলোর খাতা কলমে বা নামমাত্র পলিসি করিয়ে কিছুদিন পর তামাদির খাতা ভারি করা ইত্যাদি এই খাতের নিয়মিত ঘটনা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকরী পদক্ষেপের ঘাটতি:
বীমা খাতের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময় আইডিআরএ নানান পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকরে কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হয়েও কিছু কোম্পানির প্রভাবে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। যা পুরো বীমা খাতের জন্য অশনি সংকেত।
২৪’র গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে নতুন নেতৃত্বে এখন আইডিআরএ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে বীমা গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের অন্যতম দাবি ধুঁকে পড়া কোম্পানিগুলোর বীমা দাবি পরিশোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, আইডিআরএ প্রতি বছর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে। যার অধিকাংশই এই খাতের উপকারে আসে না। কিন্তু মূল জায়গায় তারা কি পদক্ষেপ নিতে পেরেছে? বিশেষ করে বীমা দাবি পরিশোধে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। অথচ বীমা দাবি পরিশোধে তাদের কঠোর হওয়ার কথা।
[240960]
লাইফ বীমায় অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ:
তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ৩টি কোম্পানি শতভাগ বীমা দাবি পরিশোধ করলেও, ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির মোট অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি ৩২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮২ টাকা। আলোচ্য সময়ে মোট দাবি উত্থাপন করা হয় ৫ হাজার ৪৪৮ কোটি ৮১ লাখ ২৪ হাজার ৬০৮ টাকা। এরমধ্যে কোম্পানিগুলো পরিশোধ করেছে ২ হাজার ৫৮ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৬ টাকা।
তবে ৩৬টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে ৩২টির কাছে প্রায় ১১ লাখ গ্রাহকের অনিষ্পন্ন বীমা দাবি জমেছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এরমধ্যে একটি কোম্পানির অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণই দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি অনিষ্পন্ন বীমা দাবি রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
এই বিষয়ে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্সুইরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান সোনালী নিউজকে বলেন, বীমা খাতে ‘দাবি পরিশোধ’ নিয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যার ফলে পুরো খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অন্যান্য সংস্কারের সাথে সাথে এখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, ২৪’র নতুন বাংলাদেশে বীমা খাতকে শক্তিশালী করতে বীমা দাবি পরিশোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মাথায় রেখে সংস্কার দরকার। এটা হতে পারে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ফান্ড তৈরি করে কোম্পানিগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া; যার মাধ্যমে বিগত দিনের গ্রাহকের প্রাপ্য বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারে।
ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজিম উদ্দিন বলেন, বীমা খাতে নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে লাইফ বীমা। অল্প কয়েকটি কোম্পানি সঠিকভাবে বীমা দাবি পরিশোধ না করায় পুরো সেক্টরে এই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে সব বীমা কোম্পানির উচিত বীমা দাবি পরিশোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া।
আলফা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও নুরে আলম ছিদ্দিকী অভি সোনালী নিউজকে বলেন, কিছু কিছু কোম্পানি বীমা দাবি পরিশোধ না করায় পুরো খাতের উপর প্রভাব পড়েছে। আমার মনে হয়, সরকার ব্যাংকে যেমন নতুন টাকা ছাপিয়ে নগদ তারল্য সহায়তা দিয়েছে তেমনি বীমা খাতেও সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এমন পদক্ষেপ খুবই প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বীমা খাতের প্রসার বাড়াতে বীমা দাবি পরিশোধ করে সবার মনে আস্থা তৈরি করার বিকল্প কিছু নেই। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে খারাপ কোম্পানিগুলোর স্থায়ী সম্পদ বিক্রি কিংবা মালিক পক্ষ থেকে টাকা নিয়ে দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নয়তো সম্ভাবনাময় খাতটি তার জৌলুস হারাবে।
বীমা দাবি নিষ্পত্তির বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ’র মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম সোনালী নিউজকে বলেন, বীমা দাবি পরিশোধের জন্য কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত আইডিআরএ তাগিদ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অনিয়মে জড়িত পরিচালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে টাকা উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা বীমা খাত সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সাথে বৈঠক করে এই বিষয়ে তাগিদ দিয়েছি। দাবি নিষ্পত্তির জন্য এর আগে স্থায়ী সম্পদ বিক্রির নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এএইচ/আইএ