ঢাকা : বর্তমানে শিল্পখাতে নানা কারণে স্থবিরতা চলছে। এরমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ালে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব শিল্পে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব হবে। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ মূল্যবৃদ্ধি শিল্প ধ্বংসের একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ)।
রোববার (১২ জানুয়ারি) বিপিজিএমইএর সভাকক্ষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সভাপতি সামিম আহমেদ।
তিনি বলেন, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নের আগে দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো চুক্তি বা ব্যবস্থা দেশবাসী গ্রহণ করবে না।
তিনি আরও বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো দেশি গ্যাসের উৎপাদন ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত না হলে আমদানিও বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় দেশের শিল্পখাত দ্বিমুখী সংকটে পড়বে। আমরা মনে করি প্রস্তাবিত দাম শিল্পের জন্য খুবই কঠিন হবে।
[241576]
সামিম আহমেদ বলেন, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। সাম্প্রতিককালে শিল্পখাত নানা সংকটের মুখে শ্রমিক অসন্তোষ ও বেতন-ভাতা বকেয়া থাকার কারণে বেশ কিছু কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পোদ্যোক্তারা আরও বিপদে পড়বেন।
বিপিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না- খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করি। গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে। তখন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া সামাল দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারা গ্যাস-সংকটের সমাধান করতে পারেনি; অনেক এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শিল্প-কারখানা চলছে রেশনিং পদ্ধতিতে। অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাস সংকটের সমাধান না করে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা দুটি উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে। দেশি গ্যাস কিনে নেয় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে। এতে প্রতি ইউনিটে তাদের গড়ে খরচ হয় ৬ টাকা ৭ পয়সা। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে খরচ হচ্ছে ৭৫ টাকার বেশি। এতে লোকসানে আছে সংস্থাটি। ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। তাই এখন এলএনজি আমদানির খরচ পুরোটাই শিল্পের ওপর চাপাতে চাইছে পেট্রোবাংলা।
[241574]
এ সময় বিপিজিএমইএ উপদেষ্টা ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে শিল্প বিঘ্নিত করা কোনো সমাধান নয়। প্রয়োজনে বাসাবাড়িতে গ্যাস বন্ধ করে দিন, সিএনজি বন্ধ করুন। কিন্তু শিল্প ধংস হলে সব শেষ হয়ে যাবে। হুট করে দাম এত বাড়লে তারা (শিল্প উদ্যোক্তারা) ব্যবসা করবে কীভাবে?
তিনি বলেন, আমি মনে করি এ অন্তর্বর্তী সরকার, কিছু সময় তারা ক্ষমতায় থাকবে। তাহলে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেন। এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকার নেবে। যেভাবে ভর্তুকি দিয়ে এ খাত এতদিন চলছে, সেভাবে চলুক।
বিপিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এ এস এম কামাল উদ্দিন বলেন, সরকারের মধ্যে এখনো ঘাপটি মেরে আছে পুরোনো দোষররা। তারা দেশের শিল্প ধংসের চক্রান্তে এখনো লিপ্ত।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কামরুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লে আমরা ভারত-চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবো না। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববাজারে যে একটি বড় অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা হারাবো।
এ সময় গ্যাস ও এলএনজির ব্যাপারে প্লাস্টিক খাতের কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
সেগুলো হলো:
১. নতুন কূপ খননে আরও বিনিয়োগ এবং আরও বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের ১৫০টি কূপ খননের প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য কিন্তু দ্রুততার সাথে এই খনন সমাপ্ত করতে হবে।
২. মিয়ানমার থেকে চীন ও থাইল্যান্ড প্রচুর পরিমাণে গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করে থাকে। চীন থেকে তারা তাদের মোট প্রয়োজনের ৬ শতাংশ এবং থাইল্যান্ড থেকে ২২ শতাংশ আমদানি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও বিগত ৫০ বছরে মিয়ানমার থেকে কোনো গ্যাস আমদানি করতে পারেনি। এ ব্যাপারে কোনো চুক্তিও সম্পন্ন হয়নি। এটি আমাদের জন্য বিরাট ব্যর্থতা। আমরা বর্তমান সরকারকে এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
৩. সংকট সমাধানে এলএনজি আমদানি থেকে শুল্ক-কর প্রত্যাহার করা যেতে পারে। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করে আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব করছি।
৪. দেশের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের স্বার্থে বর্তমান গ্যাসের মূল্য ৩০ টাকা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করছি।
৫. স্টেকহোল্ডারদের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে বাস্তবতার নিরিখে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করছি।
এমটিআই