ঢাকা : বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে আজ সোমবার থেকে শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার সঙ্গে চুক্তি হবে। অংশগ্রহণকারী শীর্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পৃথক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনে পাঁচ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা পুরস্কার দেওয়াসহ বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে থাকছে নানা আয়োজন।
রোববার (৬ এপ্রিল) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিনিয়োগ সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন বিডার নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
তিনি বলেন, ‘৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিনব্যাপী সম্মেলনে আয়োজক বাংলাদেশসহ অর্ধশতাধিক দেশের সাড়ে ৫ শতাধিক শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করবেন। সম্মেলনটি ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারিত হবে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ইন্টারভিউ নিতে মিডিয়া কর্নার থাকবে।’
[247207]
বিডার নির্বাহী পরিচালক বলেন, আগামী ৯ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিনিয়োগ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন। ওইদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে পাঁচ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে রয়েছেন একজন স্থানীয় বিনিয়োগকারী, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী, এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (ইএসজি) সংশ্লিষ্ট এক সংস্থা এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য পুরস্কৃত করা হবে একটি কোম্পানিকে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে বছরের পর বছর কাজ করছেন এমন একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সম্মাননা পুরস্কারের পাশাপাশি অনারারি সিটিজেনশিপ অফার করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই পুরস্কার তুলে দেবেন।
আশিক মাহমুদ বিন হারুন আরও বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা খুবই আগ্রহী। তিনি নিজেই চেয়েছিলেন বিদেশি বড় বড় বিনিয়োগকারী যারা আসবেন চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে, তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন।’
সম্মেলনে অনেকগুলো সমঝোতা স্মারক সই হবে উল্লেখ করে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিভিন্ন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। আইএলওর সঙ্গে শ্রম বিষয়ে একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করার চিন্তা করছি। আমরা নাসার সঙ্গে একটি চুক্তি সই করার কথা চিন্তা করছি। বেসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধান নিয়ে এই চুক্তি সই হতে পারে। চুক্তি সই হওয়ার পর আমরা এর বিস্তারিত জানাতে পারব।’
বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ দেখাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানানো হয় ব্রিফিংয়ে।
এলএনজি আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা : বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের প্রভাবের পাশাপাশি বিনিয়োগের বাধা হিসেবে শিল্প-কারখানায় জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে ঘাটতির বিষয়ে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনার কথা জানান আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলছি যে, কীভাবে আমরা বাণিজ্য ঘাটতিটা কমাতে পারি। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে একটা বড় টপিক হচ্ছে জ্বালানি।’
‘ট্রাম্প প্রশাসন আসার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওনারা এলএনজি রপ্তানি করবেন। সে ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যে আমেরিকার সঙ্গে কথা বলছি। সুতরাং আমাদের জন্য জ্বালানি আমদানির নতুন একটা উৎস তৈরি হয়েছে, জিসিসি (গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল) মার্কেটগুলোর বাইরে,’ বলেন বিডা চেয়ারম্যান।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস কিনলে আরোপিত শুল্কের প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি জ্বালানির উৎসের বহুমুখীকরণও হবে। আমরা যদি ওই (যুক্তরাষ্ট্র) মার্কেটটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি, আমার ধারণা, জ্বালানি সরবরাহের এই যে সংকট বা ঘাটতি আছে, সেটাকে আমরা মেটাতে পারব। সেটা করতে পারলে আমার মনে হয় না এটা নিয়ে সমস্যা হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে কথা বলছিলাম, বাণিজ্যটা কীভাবে আবার ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারি। যখন আমাদের হাই-রিপ্রেজেনটেটিভ গিয়েছিলেন, তখন ইউএসটিআর থেকে বলেছিল, তোমরা এই প্রশাসনের প্রথম দেশ, যারা এসে বলেছে, তোমরা বাণিজ্য ঘাটতিটাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে চাও। এই কথাটা ওনারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন। সেটার ওপর ভিত্তি করে আমরা ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের সময়সীমার মধ্যেই সুন্দরভাবে একটা পদক্ষেপের দিকে যাব।’
এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘আমরা সলিড একটা পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে পারব। আমরা একেবারেই চিন্তিত না।’
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি থেকে ইতিমধ্যে এলএনজি কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ ১১ মার্চ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ওই কোম্পানি থেকে প্রায় ৬৬৪ কোটি ৪০ টাকা ব্যয়ে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়।
বিনিয়োগ সম্মেলনে জ্বালানি ঘাটতির বিষয়ে কী নিশ্চয়তা দেওয়া হবে এ প্রশ্নে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যাটা গ্যাস সরবরাহে। বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহের ৫০ শতাংশ আমরা উত্তোলন করি আর বাকি ৫০ শতাংশ আমাদের আমদানি করতে হয়।’
‘আমদানি করা গ্যাসের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা আমরা মোকাবিলা করেছি, যেহেতু আমাদের ডলারের সংকট ছিল, সেই সংকটটার কারণে অনেক সময় আমরা পেমেন্টটা করতে পারিনি। পেমেন্ট করতে না পারার কারণে আমাদের সুনামের ইস্যু হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে আমরা যখন নতুন কার্গো আনার জন্য সাপ্লায়ার কনট্রাক্টের জন্য আরএফপি (প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ) করছি, তখন আমরা আসলে মূল্যের দিক থেকে ভালো কার্গো পাচ্ছিলাম না,’ যোগ করেন তিনি।
ডলারের রিজার্ভে স্থিতিশীলতা আসার পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার কথা তুলে ধরে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ‘গভর্নর এখন বলছেন, ওনার হয়তো আইএমএফের অর্থায়নটা নাও লাগতে পারে আমাদের এই স্থিতিশীলতার জন্য। যখন আমাদের এই তারল্যটা তৈরি হয়ে যাবে, আমরা আসলে পেমেন্টগুলা করতে পারব, তখন এই যে, ৫০ শতাংশের ঘাটতিটা, যেটা আমাদের আমদানি করে আনতে হয়, সেটা খুব সহজ হয়ে যাবে আমাদের জন্য।’
সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ।
মার্কিন শুল্কারোপ বাংলাদেশের জন্য সুযোগ : ব্রিফিংয়ে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘ট্রাম্পের নতুন নীতির কারণে বাংলাদেশে শুধু এককভাবে প্রভাব পড়বে তা কিন্তু নয়। প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের সঙ্গে একই নৌকায় আছে। সুতরাং, তাদের যাত্রা যে পথে হবে, আমাদেরটাও সম্ভবত সেদিকেই হবে।’
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের বিষয়টিকে আমি সুযোগ হিসেবেই দেখছি। কারণ যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভের একটা রিপোর্ট আছে বাংলাদেশের বিষয়ে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের যে অবস্থা, সেটির বিষয়ে রিপোর্ট করা হয়েছে। সেই রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই রিপোর্টে আমাদের জন্য বেসিক কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের রেগুলেটরি কিছু রিফর্ম, কাস্টম ডিউটির ক্ষেত্রে, দুর্নীতি এ রকম বেশ কয়েকটি বিষয়ে রিফর্মের কথা বলা হয়েছে।
এ সংস্কারগুলো কিন্তু আমরাও করতে চাচ্ছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকার চাচ্ছিল, বাংলাদেশের যে বিনিয়োগ ব্যবস্থা, এখানে একটা বড় ধরনের সংস্কার হোক, যাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্যবসা করা সহজ হয়।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক আমাদের জন্য একটি লাভবান হওয়ার মতো অবস্থা। আমি মনে করি, এই সুযোগে আমরা আমাদের বিনিয়োগ ব্যবস্থার ওপর অনেকগুলো সংস্কার করে ফেলতে পারব। সেটা আমাদের জন্য আসলে ভালোই হবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশের অগ্রগতি আনা সম্ভব।’
ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর।
এমটিআই