ঢাকা : মহামারী করোনা সংক্রমণরোধে চলমান বিধিনিষেধের মাঝেও একে একে দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরই খুলে দেওয়া হয়েছে।
কল-কারখানা, গণপরিবহন, দূরপাল্লার পরিবহন, দোকানপাট, অফিস, আদালত থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই যা করোনা সংক্রমণের ভয়ে বন্ধ রয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় একদিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যাও দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ফলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা চান যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত শিক্ষাবিদ ও গবেষকদেরও।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক স্তরের কমপক্ষে ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি। অন্যদিকে, অনলাইনে দূরবর্তী শিখন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ডডেভলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ছাড়াও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৩৪ লাখ এবং মাধ্যমিকের প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে।
পিপিআরসি এবং বিআইজিডির গবেষণা বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। যেসব শিশুরা সমাজের দরিদ্রশ্রেণিভুক্ত, তাদের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন।
অনেকদিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষায় ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। একারণে এখন আর করোনাকে নিয়ে ভীত হওয়ার পরিবর্তে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত অভিভাবকরা।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮৪% অভিভাবকই করোনা সংক্রমণ নিয়ে এখন আর আগের মতো চিন্তিত নন। আর বাকি ১৪% করোনা সংক্রমণ নিয়ে কম চিন্তিত।
রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাঁওলী শামরিজার মা জাহিদা পারভেজ ছন্দা বলেন, ‘আমরা সন্তানদের নিয়ে প্রচণ্ড রকমের অশ্চিয়তার মধ্যে আছি। শিশুরা পড়াশোনার ধারে কাছে যাচ্ছেনা। সারাক্ষণ মোবাইলে গেমস খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর অনলাইনে ক্লাস শুরু হলে ঘুমিয়ে পড়ে। সারাক্ষণ বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে এখন সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে যায়।
সুতরাং, শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখার যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে তা কেউই মানছেনা; বরং আমরা চিন্তিত যে, বাচ্চারা লেখাপড়া থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, পরবর্তীতে তারা শিক্ষায় মনোযোগী হবে কিনা তা নিয়েই সন্দিহান।’
শামীমা বেগম স্বপ্না নামের এক অভিভাবক জানান, তার ছেলে নারায়ণগঞ্জ সরকারি পলিটেকনিকে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরিজীবী হওয়ায় যে সময়টাতে তারা অফিসে থাকেন সে সময় তাদের সন্তান বাসায় একা কি করে তা নিয়েই সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতে হয়।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাসের পর মাসতো আর সন্তানকে বাসায় বন্দি করে রাখা যায় না। ফলে আমরা যখন অফিসে চলে যাই সে চলে যায় বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। আর বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভিডিও গেমস আর টিভি দেখেই সময় কাটিয়ে দেয়। লেখাপড়া একদম মন নেই তার।’
সন্তানকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত শামীমা বেগমের দিন কাটে সন্তানের বখে যাওয়ার আতঙ্কে। তিনি বলেন, ‘ইদানিং তার মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে পড়েছে।
এছাড়া, প্রায়ই মাথাব্যথায় ভোগে। ডাকলে সাড়া দেয়না। একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে আমরা দিন পার করছি। আমি যদি এমন কোনো মাধ্যম পেতাম যে সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যা বলার, তাহলে তাই করতাম। তাকে দ্রুত স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার অনুরোধ করতাম।’
পিপিআরসি এবং বিআইজিডির গবেষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে অভিভাবকদের মতামত নেওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, ৪৮% অভিভাবকই শিক্ষার ঘাটতি এবং ৫৯% অভিভাবক শিক্ষার প্রতি সন্তানদের অনুৎসাহ নিয়ে চিন্তিত। এছাড়া, ৩১% অভিভাবক অটোপাসে কর্মসংস্থান হওয়া নিয়ে চিন্তিত।
এদিকে, অনলাইনে ক্লাসের কথা বলা হলেও নামিদামি কিছু স্কুল ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম তেমন সচল নেই। এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েও সুফল মিলছেনা।
রাজধানীর মিরপুরের মনিকানন উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সালাহউদ্দিন চৌধুরী জানান, স্কুলের পক্ষ থেকে বেশিরভাগ ক্লাসই (অনলাইনে) নেওয়া হয়না। এ ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েও সমাধান মেলেনি। হাতেগোনা দু-তিনটি ক্লাস নেওয়া হয়।
এছাড়া, পরীক্ষার উপাদানগুলো ঠিকভাবে দেওয়া হয়না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাই বলেন, অভিযোগ কিছুটা সত্য। তবে এর পেছনে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাসে অনীহাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় নির্ধারিত সময়ে শিক্ষকরা ক্লাস শুরু করলেও দেখা যায় মাত্র ২ থেকে ৩ জন অংশ নিয়েছে।
তাছাড়া, শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা ইংরেজি, অংকের ক্লাসের বিষয়ে যতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন অন্যান্য ক্লাসের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না। ফলে এসব বিষয়ের শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে অনেক সময় হয়তো ক্লাস নেন না।’
যদিও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে এমন সমস্যা নেই। সেখানে অনলাইনে প্রায় শতভাগ স্কুলেই ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। উত্তরার স্কলাস্টিকা স্কুলের এ-লেভেলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শারমিন মোস্তফা কনি জানান, তার ছেলে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা চলছে। এনিয়ে তেমন সমস্যা হচ্ছেনা। তবে সরাসরি ক্লাস ও পরীক্ষার যে সুফল তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই তিনিও স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুদের একটা বড় অংশ শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং, শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে শিশুদের খাপ খাওয়াতে স্কুল পুনরায় খোলার সময় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার একটি মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সমস্যাগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি দ্রুত স্কুল কলেজ খুলে দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে পিপিআরসির চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোভিডের কারণে একটি অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করছি।
আমাদের পরামর্শ হচ্ছে শিক্ষার ঘাটতি ঠেকাতে, শিক্ষায় অনাগ্রহ কমাতে এবং অভিভাবকদের শিক্ষাসংক্রান্ত আশংকা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার।’
সোনালীনিউজ/এমটিআই