বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘১৫ শতাংশ’কর

ফের উত্তপ্ত হতে পারে শিক্ষাঙ্গন!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২১, ০২:০৭ পিএম

ঢাকা : ২০১৫-১৬ অর্থবছরের খসড়া বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ১০ শতাংশ মূসক চালুর প্রস্তাব করা হয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে রাজধানী, পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন। একপর্যায়ে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ করার প্রস্তাব দিলেও আন্দোলন থামেনি। বাধ্য হয়ে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ও মেডিকেল কলেজ। বাজেট উত্থাপনের একদিন পরই এই কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর ফলে তাদের শিক্ষার ব্যয় আরও বাড়বে। করোনাকালীন এ ধরনের সিদ্ধান্তে ড্রপ আউট (ঝরে পড়া) বাড়বে। উচ্চ শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে ২০১৫ সালের ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ নামে যে গণআন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলন করতে এবারও তারা মাঠে নামবেন।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মালিকরা বলছেন, ১৫ শতাংশ কর আরোপের ফলে উচ্চ শিক্ষা সংকুচিত হবে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকার যতই বলুক এ কর প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত তা শিক্ষার্থীদের ওপর দিয়ে যাবে।

শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে কর প্রত্যাহারসহ ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনেরও হুমকি দেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ছাত্র মুক্ত রেজোয়ান। পরে তিনি বলেন, সরকার আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এ কর আরোপ করতে যাচ্ছে। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাহলে কর দেবে কোন খাত থেকে? যদি তা-ই হয় তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই আয় বা লাভ করে।

সেই আয়-ব্যয়ের হিসাব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসিকে নিতে হবে। অন্যথায় আমরা ধরে নেব, মালিকরা মুনাফা করে। সেটার বৈধতা দিতেই এ উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত এ কর শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তাবে। তাই ১০ জুনের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে ২০১৫ সালের চেয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সারাদেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করছি- যোগ করেন তিনি।

সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কথা না বলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আইনসিদ্ধ হয়নি। ২০১৫ সালে ভ্যাট আরোপের ফলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। এবারও যদি সেরকম কিছু হয়, এর দায়ভার কিন্তু আমরা নেব না

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কথা না বলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আইনসিদ্ধ হয়নি। ২০১৫ সালে ভ্যাট আরোপের ফলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। এবারও যদি সেরকম কিছু হয়, এর দায়ভার কিন্তু আমরা নেব না। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, এ কর আরোপ প্রত্যাহার চাই।

কারণ, এর ফলে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বাড়বে। এটি নির্বাহ করতে না পেরে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দেবেন। করোনার এ সময়ে এটি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা কোনো ব্যবসা নয়। এটি সামাজিক সেবা। এখানে কর আরোপ অযৌক্তিক। এছাড়া আইনও সেটি সমর্থন করে না। এটি চালু হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার মান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ২০১৫ সালে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়। ওই সময় সরকারের যুক্তি ছিল, আরোপিত ভ্যাট মালিককে দিতে হবে।

আমার প্রশ্ন হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে তো লাভ হওয়ার কথা নয়। তাহলে কর দেবে কোথা থেকে? এটি সাংঘর্ষিক হবে। শেষ পর্যন্ত এটি  শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তাবে এবং বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার ব্যয় আরও বাড়বে।

কোথা থেকে কর আদায়, এখনও পরিষ্কার নয় : বর্তমানে দেশে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টিউশন ফি। এটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভবন ভাড়াসহ সব ব্যয় নির্বাহ হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক হওয়ায় এখানকার সব খরচ বাদ দিয়ে যে আয় হয় তা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করতে হয়। সরকার এখন যে করের কথা বলছে তা এই উন্নয়ন খাত থেকে প্রযোজ্য হবে নাকি পরিচালন ব্যয় হিসাবে যে টাকা খরচ হচ্ছে সেটির ওপর দিতে হবে- বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ভালো করেই জানে যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের উৎস হলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। তাই তাদের বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করতে হলে শিক্ষার্থীদের ওপরই চাপ বাড়বে। আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফা করতে পারবে না। বর্ধিত আয় শিক্ষার উন্নয়নেই ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এটা দিতে হলে তাদের সেই শিক্ষার উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তরা বলছেন, ভ্যাট আরোপ করা হয় সাধারণত পণ্যের ওপর। কিন্তু শিক্ষা তো পণ্য নয়; সামাজিক সেবা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে পড়াশোনা করেন তাদের ওপর না ধরে যারা বেশি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা নিচ্ছেন, তাদের ওপর এটি চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক।

কী ঘটেছিল ২০১৫ সালে : ২০১৫-১৬ অর্থবছরের খসড়া বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষার ওপর ১০ শতাংশ মূসক চালুর প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে প্রচুর সমালোচনার আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তা কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়। তাতেও আন্দোলন থামেনি। পরে পুরো ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়।

বাজেট ঘোষণার পরের দিন থেকেই আন্দোলনে নামেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গোটা রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। টানা এ আন্দোলনে ছাত্রলীগ কয়েক দফা হামলা চালায় বলেও অভিযোগ ওঠে। অর্থ মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচিও হাতে নেয়া হয়। কিন্তু পুলিশের বাধা আর লাঠিপেটায় তা ভুন্ডল হয়ে যায়। জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ আন্দোলন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ায়।

২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আফতাবনগরের ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ভ্যাট মওকুফের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি চালায়। এতে প্রায় ২৩ শিক্ষার্থী আহত হন। ওই ঘটনার পর সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।

এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন। ওই সময় বেশির ভাগ মানুষ এ আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। এরপরও বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

ধানমন্ডির ২৭ নম্বর ও কাকলি মোড়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে। দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ওইদিনই অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভ্যাট প্রত্যাহারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়।

অভিন্ন টিউশন ফি’র নীতিমালা চায় শিক্ষার্থীরা : প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০ জুনের মধ্যে বাতিল না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেন তারা।

গত শুক্রবার দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে 'নো ভ্যাট অন এডুকেশন' ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা ছয়টি দাবি উপস্থাপন করেন।

দাবিগুলো হলো- ১৫ শতাংশ কর বাতিল করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব ইউজিসিকে খতিয়ে দেখতে হবে; সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন টিউশন ফি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করতে হবে; গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে; শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নিশ্চিতে প্রণোদনা দিতে হবে।

মালিক সমিতির ভাষ্য : ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর আরোপ প্রত্যাহার চেয়ে অস্তিত্ব সংকটে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।

শুক্রবার (৪ জুন) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের এ সংগঠনের পক্ষে সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনার দুর্যোগে অর্থ সংকটে পতিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ক্যাম্পাস ভাড়া পরিশোধ করা অনেক ক্ষেত্রেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একমাত্র অর্থপ্রাপ্তির উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না।

এ অবস্থায় কর আরোপ নয়, সরকারের উচিত প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে সহায়তার হাত প্রসারিত করা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই