অদম্য এক শিক্ষকের গল্প

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২১, ০৪:০১ পিএম
সংগৃহীত ছবি

ঢাকা: বি অনেস্ট ইন ইউর লাইফ— তোমার জীবন সৎ হোক। আই এম আ মুসলিম— আমি একজন মুসলমান। এভাবে বাচ্চাদের সুর করে পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। শুনে মনে হতে পারে, কোনো ইংলিশ মাধ্যম স্কুলের পাঠদান চলছে। একটু পরেই আবার পড়াচ্ছেন বাংলা। সমাধান করছেন গণিতের মারপ্যাঁচ। এবার হয়তো ভাববেন, এটা বাংলা মাধ্যম স্কুল।

আরও পড়ুন: স্কুলের প্রধান শিক্ষক এখন চা দোকানদার

আসলে এটি ইংরেজি বা বাংলা মাধ্যম কোনো বিদ্যালয় নয়, শহুরের অভিজাতপাড়ার কোনো বিদ্যালয়ও নয়। এটি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুর ইউনিয়নের নিভৃতপল্লির খিদিরপুর আফজালুল উলুম কওমি মাদ্রাসা।

এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন আমিনুল ইসলাম। তবে আমিনুল মানসিকভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হলেও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তার হাত-পা সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ। কিন্তু পায়ের আঙুল দ্বারা তিনি লিখতে পারেন বোর্ডে। তার নিখুঁত লেখা দেখে মুগ্ধ হবে যে কেউ। তাই শিক্ষার্থীদেরও তার ক্লাস করতে ও বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। তাদের কাছে বরং তিনি প্রিয় শিক্ষক।

আরও পড়ুন: পদোন্নতির আশ্বাসে গুড়েবালি, প্রধান শিক্ষকদের ক্ষোভ

আমিনুল জানান তার জীবনের হার না মানা নানা অধ্যায়। ১৯৮২ সালে মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন আমিনুল। জন্মগতভাবেই হাত-পা বিকলাঙ্গ তার। ছোটবেলায় অন্যদের পড়ালেখা দেখে তারও স্বপ্ন হয় পড়ালেখা করার। একদিন তার বোন তার নাম মাটিতে লিখে দেন। তিনি সেই লেখার ওপর পায়ের আঙুল দিয়ে চর্চা করেন। এভাবেই রপ্ত করেন পা দিয়ে লেখা।

এদিকে পরিবার তাকে ভর্তি করান গ্রামের একটি স্কুলে। স্কুল থেকে প্রতি মাসে কিছু সাহায্যও পেতেন। সেটা দিয়ে চলত তার পড়াশোনার খরচ। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠতেই বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। তারপর বাবার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সাংসারিক কাজে। বড় হওয়ার পর পরিবার তাকে বিয়ে দেন।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষক মারা গেলে সন্তানদের দায়িত্ব নেবে ট্রাস্ট

বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারে নেমে আসে আরও অন্ধকার। তিনি তখন নতুন করে পড়াশোনার কথা ভাবলেন। ভর্তি হলেন স্থানীয় খিদিরপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আবার পড়াশোনা বন্ধ হয়। পরের বছর আবার রেজিস্ট্রেশন করে শুরু করেন পড়াশোনা।

এবার আর হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালে খিদিরপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১১ সালে আকবর আলী খান কারিগরি বাণিজ্য কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। স্বপ্ন ছিল সরকারি দফতরে চাকরি করবেন। কিন্তু পেছনে যে বয়স অনেক হারিয়ে ফেলেছেন। সে কারণে আমিনুলের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।

আরও পড়ুন: পদোন্নতির তালিকায় মৃত শিক্ষকরাও

অবশেষে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রতি মাসে সম্মানী হিসেবে পান মাত্র দুই হাজার টাকা। তখন থেকে চার বছর ধরে আমিনুল এখানেই শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন।

আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল সরকারি চাকরি করব। কিন্তু সেটা পূরণ হয়নি বয়সের কারণে। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে পাই মাত্র দুই হাজার টাকা। এতে সংসারের কিছুই হয় না। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে একটি ভাঙা ঘরে বসবাস করি। বৃষ্টি হলে খুব কষ্ট হয়। তবে শিশুদের পড়াতে কষ্ট হয় না আমার। বিষয়টা আমি উপভোগ করি।

মাদ্রাসায় যাতায়াত করেন কীভাবে? তিনি বলেন, বাড়িতে হুইলচেয়ার আছে। প্রতিদিন সকালে এক ছাত্র এসে সাইকেলে করে নিয়ে যায়। সন্ধ্যায় আবার দিয়ে যায়। সারাদিন কাটে মাদ্রাসাতেই। এখন আমার তেমন কোনো চাওয়া নেই। যদি সরকার মনে করে আমার জন্য কিছু করবে। তবেই আমি খুশি।

আমিনুলের ছোট ভাই আবুদল আজিজ বলেন, আমার বড় ভাই অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন মানুষ। তিনি শারীরিক বিকলাঙ্গ হয়েও পড়ালেখা করেছেন, আমাদের খেয়াল রেখেছেন, বড় ভাই হয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধ করছেন। আমাদের পরিবারের দাবি, সরকার এই জীবনযোদ্ধাকে একটু সহায়তা করলে বাকি জীবন একটু শান্তিতে কাটাতে পারবেন।

আমিনুলের সহকর্মী শিক্ষকরাও মুগ্ধ তার অবদানে। এক সহকর্মী আবদুল বাতেন খুদরি বলেন, অমানবিক সংগ্রাম করে যাওয়া আমিনুলের দিন কাটে অভাব ও দৈন্যতায়। মাদ্রাসা থেকে যে বেতন দেওয়া হয়, তাতে একটা সংসার চলা এ যুগে কঠিন ব্যাপার। অনেক শিক্ষকই পাশাপাশি অন্য কিছু করেন। কিন্তু তার সেই সামর্থ্যটুকু নেই। এখন সমাজের সুধীজন বা সরকার যদি তার দিকে তাকায়, তবে তার জীবনে একটু সুখ আসবে।

মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম কাসেম বলেন, ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা হয়েছে আমিনুলের। আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। মাসে মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা তিনি পাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে কোনো সুযোগ এলে তার জন্য অগ্রাধিকার থাকবে। তা ছাড়া শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে সমাজের বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

সূত্র-ঢাকা পোস্ট

সোনালীনিউজ/আইএ