ঢাকা : বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায়। বিপুলসংখ্যক এসব শিক্ষার্থীর একসঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ ও খাতা মূল্যায়নসহ দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে মোকাবিলা করতে হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। এর ফলে ফল প্রকাশসহ অন্যান্য কাজে ধীরগতি দেখা দেয়। দ্রুত ফল প্রকাশের জন্য অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দৌড়াতে হয় পরীক্ষা ও ফলের পেছনে। এসব কারণে এবার প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এরই মধ্যে গত বছর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষা বোর্ড আইনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু এরপর আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এক বছরের বেশি সময় পর গত ৭ নভেম্বর মতামত ও সুপারিশের জন্য আইনের খসড়াটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পাঠানো হয়। আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে খসড়াটির ওপর মতামত ও সুপারিশ পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়।
জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আদলে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। এই বোর্ডের অধীনে প্রাথমিক স্তরের (পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা, জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ, গবেষণা ও সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনার গুণগত মানোন্নয়ন করা হবে। তবে ইবতেদায়ি মাদরাসা এই বোর্ডের অধীনে থাকবে না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সে হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইনে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই বোর্ডের আওতায় থাকবে।’ ইবতেদায়ি এই বোর্ডের অধীনে থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা আইনে (খসড়ায়) সাধারণ, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা এই তিনটি ধারা। সে কারণে ইবতেদায়ি এই বোর্ডের অধীন থাকবে না। তা ছাড়া ইবতেদায়ি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়।’
‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে বোর্ডের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের ক্ষমতা থাকবে। বোর্ডের অনুমোদনে সম্পত্তি হস্তান্তরের চুক্তি করা এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণ, অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষমতা থাকবে। তবে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর ও বিক্রির আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া এই আইনের বিধান অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার সংগঠন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের জন্য চাহিদাভিত্তিক প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন, স্থানান্তর বা বিলুপ্ত করতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষা সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান, পরিচালনা ও উন্নয়নের ক্ষমতা থাকবে বোর্ডের। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। দেশের অভ্যন্তরে যে-কোনো স্থানে এক বা একাধিক বোর্ড স্থাপনে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ করবে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকবেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো মহাপরিচালক, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিবের নিচে নয়), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিবের নিচে নয়), লেজিসলেটিভ বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিবের নিচে নয়), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিবের নিচে নয়), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সদস্য হিসেবে থাকবেন। এ ছাড়া সরকারি মনোনীত তিন জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বোর্ডের দুই জন পরিচালক, (একজন শিক্ষা পরিসংখ্যান ও মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক মনোনীত একজন পরিচালক সদস্য হিসেবে থাকবেন। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব এই বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব থাকবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের কাজ হবে প্রাথমিক শিক্ষায় সুষ্ঠু মূল্যাযয়ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে নীতি, পরিকল্পনা ও গাইডলাইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম সম্পাদনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজের সমন্বয় করা। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার সুষ্ঠু মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বিষয়ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রক্রিয়াজাত করবে বোর্ড।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করবে বোর্ড। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষা কেন্দ্র ও ভেন্যু অনুমোদন, শিক্ষার্থী অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান বিভাজন, ডেসক্রিপটিভ রেজিস্ট্রেশন, বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্রের চাহিদা পাঠানো ও মুদ্রণ প্রভৃতি।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার শিখন মূল্যায়নের ফলাফল প্রকাশ, প্রচার ও বিতরণ; শিখন মূল্যায়ন সংক্রান্ত বিষয় পরিবীক্ষণ ও গবেষণা করে মানোন্নয়নের সুপারিশ দেওয়া এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সরকারের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে বৃত্তির ফলাফল ঘোষণা করবে বোর্ড। ফলাফল ঘোষণার ক্ষেত্রে বোর্ড প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বৃত্তি দেওয়ার সূচক সংশোধনের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ প্রদান, নাম ও বয়স সংশোধন, ডুপ্লিকেট সনদ প্রদান ও প্রয়োজনে প্রদত্ত সনদ প্রত্যাহার করবে।
সরকারের অনুমোদন নিয়ে বোর্ডের আধিকারিক এবং এই আইনে বিধানগুলো প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ পরামর্শকদের পদ সৃষ্টি ও বিলুপ্তি করাসহ সংখ্যা, পদবি বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য প্রাপ্তি নির্ধারণ করবে। প্রবিধানমালায় ফি নির্ধারণ, দাবি ও আদায়, উপহার ও দান করা সম্পদ গ্রহণ ব্যবস্থাপনা, বৃত্তি, পদক ও পুরস্কার প্রচলন এবং বিতরণ করবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই