ঢাকা : প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে। দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকায় নিয়োগ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব চাকরি প্রার্থীরা।
এনটিআরসিএ বলছে, নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া সবার পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়নি। এই কাজ শেষ হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে।
এ বিষয়ে এনটিআরসিএ সচিব ওবায়দুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথম দফায় ৩২ হাজার দুইশর বেশি ফরম পাই। পরে আরও এক হাজারের মতো ফরম পেয়েছি। সেগুলো ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো আপডেট নেই। পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ চলছে। কবে নাগাদ শেষ হবে তাও জানি না।
ওবায়দুর রহমান বলেন, নতুন সচিব আসার পর আমাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল। তবে এখনো সেটা হয়নি। এই সপ্তাহে বা আগামী সপ্তাহে বসতে পারে। তখন আমরা বিস্তারিত জানাব। সেখান থেকে আপডেট পাওয়া যেতে পারে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন চলমান আছে। আশা করছি, দ্রুতই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে।
এদিকে নিয়োগপ্রত্যাশীরা বলছেন, ব্যক্তি ভেরিফিকেশনের পর প্রতিষ্ঠান ভেরিফিকেশন হবে। এতে লেগে যাবে দীর্ঘ সময়। বছরখানেকের মধ্যে শেষ হবে কিনা সন্দেহ আছে।
তারা আরো বলছেন, মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্যমূলক নীতি চালু রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর গত বছরের ১৪ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনের আলোকে অধিদপ্তরাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে দুই শতাধিক প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। ওই প্রার্থীদের আগাম কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকেও অনেক প্রার্থীকে নন- টেক ইন্সট্রাক্টর পদে চূড়ান্ত নিয়োগ দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
এনটিআরসিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত শূন্যপদ ধরে গত ৩০ মার্চ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে ৫৪ হাজার ৩০৪টি পদ ফাঁকা ছিল। গত ১৫ জুলাই তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশ করা হয়। তবে ৫১ হাজার ৭৬১টি পদে সুপারিশের কথা থাকলেও ৩৮ হাজার ২৮৬ জন প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ৩৪ হাজার ৬১০ জনকে এবং নন-এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৬৭৬ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে। আর ৮ হাজার ৪৪৮টি পদে কোনো আবেদন না পাওয়ায় এবং ৬ হাজার ৭৭৭টি নারী কোটা পদে নারী প্রার্থী না পাওয়ায় মোট ১৫ হাজার ৩২৫টি পদে ফলাফল দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এছাড়া ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরসহ বিভিন্ন পদে আগাম ভেরিফিকেশন ছাড়াও অনেক নিয়োগ সম্পন্ন করেছে দপ্তরটি। তাদের প্রশ্ন পুরোপুরি সরকারি নিয়োগে ভেরিফিকেশন ছাড়াই নিয়োগ হচ্ছে। অথচ আমাদের কেন ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শূন্যপদ থাকায় প্রতিষ্ঠান খোলার পরও পাঠদানের ধারাবাহিকতা রক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে হতাশায় এমনই এক প্রার্থী নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জের গোলাম রব্বানী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রত্যাশী। ১৫তম শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করেছেন তাও দুই বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিয়োগ পাননি তিনি। জীবন-জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়েই বেছে নিতে হয়েছে রড মিস্ত্রির কাজ।
গোলাম রব্বানী বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভাইভা দিয়েছি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফল হয়েছে। ধারণা করেছিলাম, তিন-চার মাসের মধ্যে নিয়োগ হয়ে যাবে। নিয়োগের আশায় কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতেও চাকরি নেইনি। বাবা অবসরে যাওয়ার পর যে টাকা পেয়েছি, তা দিয়ে বোনদের বিয়ে ও দুই ভাইকে বাড়ি করে দিয়েছি।
গোলাম রব্বানী আরও বলেন, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা আছেন। সাত-আট বছর আগে অবসরে গেছেন। বাবার হাতে এখন কোনো টাকাই নেই। জমি সব বন্ধক আছে। এর মধ্যে কিছু বিক্রিও করতে হয়েছে। ২২ মাসের সন্তানকে নিয়েও মহাবিপদে আছি। তার পেছনে প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এ টাকা কই পাই? কি যে কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছি, সেটা বলে বুঝানো যাবে না। বাধ্য হয়ে ২৮-২৯ দিন হলো কঠোর পরিশ্রমের কাজ শুরু করেছি।
এর আগে রংপুরে টিউশনি করাতাম জানিয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে এখন টিউশনিও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন রাজধানীর বাড্ডার আফতাবনগরে কাজ করি। এ কাজে ৪৫০ টাকা করে পাই প্রতিদিন। খরচ শেষে থাকে ৩০০ টাকা। একমাস কাজ করার পর ৯ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যাব। বাইরে থেকে মানুষ দেখে পাকা বাড়ি। কিন্তু নিরুপায় হয়েই এই কাজ করতে হচ্ছে। আমার একমাত্র দাবি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করা।
আরেক নিয়োগ প্রত্যাশী মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার আবদুর রহিম। তার দুই ছেলে ফাহিমের বয়স ১২ বছর আর আয়ানের চার। ফাহিম তিন বছর ধরে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। রাজধানীর মহাখালীর একটি হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা। তার পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে বড় অংকের টাকা। ১৪তম নিবন্ধনে সুপারিশপ্রাপ্ত তিনি। কিন্তু নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতায় বেহাল দশা তার।
আবদুর রহিম বলেন, ঘর থেকে বের হতে পারি না। সবাই হাসাহাসি করে। বলে যে, নিয়োগের সুপারিশ পাওয়ার পরও কেন কাজে যোগদান করছি না। আসলেই কি সুপারিশ পেয়েছি কিনা এটা তাদের সন্দেহ।
এনটিআরসিএর বিষয়ে তিনি বলেন, অন্য চাকরির বেলায় ভাইভায় পাস করলেই চাকরি, কিন্তু আমরা বৈষম্যের শিকার। পুলিশ ভেরিফিকেশন করা দরকার আছে। কিন্তু এত সময় লাগবে কেন?।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে পাস করে বের হয়েছেন বাগমারা উপজেলার নাজমুল সরদার। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাকি দুই ভাইয়ের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আরেকজন এবার ক্লাস নাইনে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা অপারেশনের পর গত ছয় মাস ধরে শয্যাশায়ী। সুপারিশের পর নিয়োগের আশায় থাকতে থাকতে শেষমেশ বাধ্য হয়ে নিজ এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়েছেন তিনি।
নাজমুল সরদার বলেন, আমি আয় রোজগার না করলে আমার পরিবার না খেয়ে থাকবে। তাই বাধ্য হয়েই রাজমিস্ত্রির কাজ করছি। তারপরও ভালো নেই। ঘর থেকে বের হলেই সবার একই প্রশ্ন, সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি কাজে যোগ দিচ্ছি না কেন?
নাজমুল সরদার বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ৩৮ হাজার প্রার্থীর ভেরিফিকেশন এটা সময়সাপেক্ষ কাজ। এনটিআরসিএ শর্তসাপেক্ষে নিয়োগ দিয়ে ভেরিফিকেশন চলমান রাখতে পারতো।
১৫তম নিবন্ধনে সুপারিশপ্রাপ্ত সিলেটের সদর উপজেলার শাহী ইদগাহ এলাকার বাসিন্দা শারমিন জাহান তন্নী। শিক্ষকতা তার পছন্দের পেশা। এজন্যই এই পেশাকে বেছে নিতে চেয়েছেন। ধীরে ধীরে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু তার স্বপ্ন এখনও অধরাই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে আছি যে, ঘর থেকে বের হতে পারি না। সবাই জিজ্ঞেস করে কবে কাজে যোগ দেব। তাদেরও দোষ নেই, তারা তো ছয় মাস আগে শুনেছে আমি নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে হতাশায় প্রার্থীরা : রব্বানী, রহিম, নাজমুল আর তন্নীর মতো বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক নিয়োগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন ৩৮ হাজার প্রার্থী।
নিয়োগপ্রত্যাশী শান্ত আলী বলেন, ছয় মাসেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এখনও পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে। সেটা কবে শেষ হবে তাও জানি না। এদিকে, ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। ৩৮ হাজার প্রার্থী অসহায় জীবনযাপন করছে।
আরেক নিয়োগপ্রত্যাশী আমিনুল ইসলাম অনন্ত বলেন, মুজিববর্ষে ৩৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে পারতো। কিন্তু তারা তাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএর সদিচ্ছা ছিল বলেও মনে হয় না।
সোনালীনিউজ/এমটিআই