ঢাকা : করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় স্কুল ও কলেজের ছুটি আরো দুই সপ্তাহ বাড়ানো হতে পারে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
যদিও অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজ খোলার চাপ বাড়ছে। করোনা মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিলও (ইউনিসেফ)। স্কুল-কলেজ বন্ধের সুযোগ নিচ্ছেন একশ্রেণির শিক্ষক। সংক্রমণ ঠেকাতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হলেও তারা বাড়িতে বা কোচিং সেন্টারে গাদাগাদি করে ক্লাস নিচ্ছেন।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব স্কুল, কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা নেবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
স্কুল-কলেজ বন্ধের পর অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম এবং অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতিতে বৈষম্য দেখা দিয়েছে বলে ইউনিসেফও মনে করে।
ওমিক্রন থেকে মানুষকে রক্ষায় স্কুল-কলেজ বন্ধসহ কিছু বিধিনিষেধের শর্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে স্কুল-কলেজ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম জোরদার করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখার চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শুধু স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি। তবে দুদিন ধরে স্থিতিশীল।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলারও চাপ আছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ধাপে ধাপে ছুটি বাড়ানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপাতত আরো দুই সপ্তাহের জন্য স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ ঘোষণা আসতে পারে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির আগেই আরো ২-৩ দিন দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই নেওয়া হবে।
সংক্রমণ কমতে থাকলে অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি না বাড়ানোর দাবি উঠেছে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষার্থীদের যেমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না তেমনি সংক্রমণ কমে গেলে ঘরে বন্দি রাখাও ঠিক হবে না। কারণ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষতি হচ্ছে এবং মানসিক দিক দিয়েও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ কমতে থাকলে আগামী আরও ৩-৪ দিন দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। আর একান্তই ছুটি বাড়াতে হলে তা ১৫ দিনের বেশি না করাই ভালো।
গত ২৮ জানুয়ারি ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে জানায়, স্কুলগুলো পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে প্রায় ৬১ কোটি ৬০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষক এবং স্কুল কর্মীদের অবিলম্বে টিকা দিন। প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মী এবং উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে কোভিড-১৯ এর টিকাদানের পরপরই এই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং স্কুল কর্মীদের সম্পূর্ণরূপে সমর্থন ও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, অগ্রাধিকার প্রাপ্য জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করার পর এবং টিকার যথেষ্ট প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে ইউনিসেফ শিশুদের টিকাদানকে সমর্থন করে। সশরীরে স্কুলে যাওয়ার জন্য টিকাদানকে পূর্বশর্ত করবেন না। কোভিড-১৯ টিকাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সশরীরে স্কুলে যাওয়ার শর্ত আরোপ করলে তা শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে।
এদিকে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির ফের অবনতি ঘটতে থাকায় স্কুল-কলেজে শারীরিক উপস্থিতিতে পাঠদান বন্ধ করা হলেও এর সুযোগ নিচ্ছেন একশ্রেণির শিক্ষক। সংক্রমণ ঠেকাতে যেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাড়িতে বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিচ্ছেন তারা।
ঢাকাসহ সারা দেশেই এমন কোচিং ক্লাসের চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর আশপাশের অলিগলিতে শিক্ষকদের এমন কোচিং সেন্টারের আধিক্য দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, স্কুলের শিক্ষকরা অবৈধভাবে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। এজন্য তারা ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিক ভবনে রুম ভাড়া নিয়েছেন। ছোট ছোট রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাচ করে পড়াচ্ছেন তারা। রুম ছোট হওয়ায় এক বেঞ্চে বসানো হচ্ছে দু-তিনজন। এতে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি।
বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার পাশে বইঘর গলির শেষ বাড়িতে নটর ডেম কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ের এক শিক্ষক নিজের কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। ওই এলাকায় ‘বিপ্লব স্যার’ নামে খ্যাত এই শিক্ষক নিয়মিত সকাল-বিকেল ব্যাচভিত্তিক বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী পড়ান। তবে বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা পড়াচ্ছেন তিনি।
গত শনিবার দেখা গেছে, ৬৪/এ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ছোট একটি রুমে ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে। ছোট ছোট বেঞ্চে দুজন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না সেখানে।
জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অনুরোধে আমি সরাসরি কোচিং ক্লাস নিচ্ছি। এমনিতে নিয়মিত অনলাইনে আমি ক্লাস নিয়ে থাকি। তাদের অনুরোধে কয়েকটি ব্যাচে অফলাইনেও ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য হলেও কিছু করার নেই। অনেক দিন থেকে কোচিং করাই বলে এলাকায় আমার একটি পরিচিতি তৈরি হয়েছে।
ওই গলিতেই ভিকারুননিসার ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষক তারেক আহমেদ ৬৩/২ নম্বর বাড়ির নিচতলার একটি রুমে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাচ করে ইংরেজি পড়ান। প্রতিটি ব্যাচে ২০-৩০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে পাশের বাড়িতে সাংবাদিক আসার খবরে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে তিনি নিজেও কোচিং থেকে বের হয়ে যান। এ সময় তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারেক আহমেদ কথা না বলেই চলে যান।
শুধু এ দুই শিক্ষক নন। একই গলিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনেক শিক্ষক ওই এলাকায় কোচিং সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। ওই এলাকায় বাইরের অনেক শিক্ষকও কোচিং খুলেছেন। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় সবারই রমরমা অবস্থা চলছে।
পাশেই সিদ্ধেশ্বরীর ৬৮/১ বাড়ির দ্বিতীয় তলার পাঁচটি রুমে সাব্বির, শাহেদ ও রাকিব নামে তিন ব্যক্তি কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে ব্যাচভিত্তিক পড়ানো। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ শিক্ষার্থী পড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সাব্বির নামের এক শিক্ষক বলেন, আমরা কোনো স্কুলের শিক্ষক নই। আমাদের জন্য আইন প্রযোজ্য হতে পারে না। সরকারি আইন স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের জন্য হতে পারে। আমরা কেন মানবো? পাশের রুমে থাকা সুফিয়ান নামে আরেক শিক্ষকও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
রাজধানীর কাকরাইল মোড়ের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জিয়াম তিন বছর ধরে বইগলির ৬৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ‘সামি স্যার’র কোচিংয়ে পড়ে। সামি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কোচিং সেন্টার চালান।
ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার ছোট একটি রুমে উইলসের ১৫ জন শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষক আসার অপেক্ষায় কোচিংয়ে বসে রয়েছে। আলাপ হলে জিয়াম বলে, সামি স্যার প্রতি ব্যাচে ২০ থেকে ৩০ জন করে পড়ান। প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে সপ্তাহে তিনদিন করে ক্লাস করান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুননাহার বলেন, শিক্ষকদের প্রতিদিন স্কুলে আসতে বলা হচ্ছে। তারা আসছেন। তার বাইরে কেউ যদি কোচিং করান তবে আমাদের কিছু করার থাকে না। যারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করবে, তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দমন করা উচিত।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, কোচিং সেন্টার নিয়ে একটি নীতিমালা রয়েছে। সেটি কেউ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার ওপর জরুরি এ অবস্থায় কোনো সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষক কোচিং করানোর প্রমাণ মিললে দ্রুত সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই