ঢাকা : বেসরকারি শিক্ষক মো. আতিকুর রহমান রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিজ্ঞান ও গণিত পড়ান। এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে তার বেতন স্কেল ১৬ হাজার টাকা। সরকারি বিধি অনুসারে ১৬ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি পান মাত্র এক হাজার টাকা।
কারণ বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না।
আতিকুর রহমান জানতে চান, এক হাজার টাকায় ঢাকা শহরের কোথাও কি পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকা সম্ভব? কোনো টিনশেড ঘরও তো এক হাজার টাকায় মিলবে না। বেসরকারি শিক্ষকরা তাহলে জীবনযাপন করবেন কীভাবে?
সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত সিনিয়র শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকার ৫০০ টাকা মাত্র চিকিৎসা ভাতা দেয়। এই বাজারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি-ই ৭০০-৮০০ টাকা। তাহলে ওষুধ কিনবেন কী দিয়ে? এই চিকিৎসাভাতা দিয়ে সুচিকিৎসা তো দূরের কথা, কোনো চিকিৎসাই করানো সম্ভব নয়।
আতিকুর রহমান ও আনোয়ার হোসেনের মতো এক হাজার টাকার বাড়ি ভাড়া আর ৫০০ টাকার চিকিৎসাভাতা নিয়ে কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সারাদেশের এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবার। নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা এ ক্ষেত্রে আরও দুর্বিষহ।
দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতন বৈষম্য চমকে ওঠার মতো। বৈষম্য রয়েছে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও। অথচ তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে একই শিক্ষাগত যোগ্যতায়। সরকারি শিক্ষকরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পাচ্ছেন।
বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকরাও কেন্দ্রীয়ভাবে 'বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের' (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাচ্ছেন। একই সিলেবাস ও কারিকুলামে পাঠদান করলেও বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৮ ভাগই বেসরকারি খাতের। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সংখ্যায়ও তারাই বেশি।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ কমিয়ে আনার কথা বলা আছে। সমযোগ্যতায় চাকরি করলে আর সমপরিমাণ শ্রম দিলে বেতন-ভাতায় বিস্তর বৈষম্য সৃষ্টি করা কাম্য নয়।
অপর এক শিক্ষক নেতা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে পার্থক্য থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। তবে বৈষম্য থাকতে পারে না। এখন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা রীতিমতো বৈষম্য।
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, দেশের ৯৮ ভাগ শিক্ষক বেসরকারি। তারা সরকার থেকে দুই ভাগ সুযোগ-সুবিধা পান। আর দুই ভাগ সরকারি শিক্ষক ৯৮ ভাগ সুযোগ-সুবিধা পান। দিনের পর দিন এ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চলতে পারে না। এ অবস্থার অবসানকল্পে একমাত্র ব্যবস্থা হতে পারে জাতীয়করণ। সেটাই এখন শিক্ষকদের মূল দাবি।
দেশে বর্তমানে সরকারি হাইস্কুল মাত্র ৩৩৫টি। আর বেসরকারি হাইস্কুল ১৬ হাজার ১০৯টি। সরকারি কলেজ মাত্র ২৭৪টি। আর বেসরকারি কলেজ দুই হাজার ২৬২টি। সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাত্র চারটি। আর বেসরকারি মাদ্রাসা সাত হাজার ৫৯৮টি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪২টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৪টি।
সঙ্গত কারণেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়াশোনা করেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক কাওছার আলী শেখ বলেন, মোট ছাত্রছাত্রীর ৯৮ শতাংশের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়ালেও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দিকে সরকারের সুদৃষ্টি কম।
সরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা : সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, সব সুযোগ-সুবিধা পান তারা। স্কেলভিত্তিক পূর্ণ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসাভাতা হিসেবে ১৫০০ টাকার পাশাপাশি বার্ষিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও পান। এর বাইরে পান স্কেলভিত্তিক উৎসব বোনাস। পরবর্তী স্কেল নির্ধারণকৃত ও চলমান আছে। ধারাবাহিক প্রমোশন আছে ও বদলির ব্যবস্থা চালু আছে।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩৫,৫০০ টাকা (ষষ্ঠ গ্রেড)। অথচ বেসরকারি প্রধান শিক্ষকদের স্কেল ২৯ হাজার স্কেল (সপ্তম গ্রেড)। সরকারি শিক্ষকদের বিভাগীয় ভাতার ব্যবস্থা আছে। অবসরের পর পরিপূর্ণ অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশন আছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্বল্প ও নির্ধারিত ব্যয় করতে হয়। সন্তানরা সরকার থেকে শিক্ষা ভাতাও পান।
সবচেয়ে বড় পার্থক্য পদমর্যাদার। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার পদমর্যাদার। কিন্তু বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো পদমর্যাদা নির্ধারণ করা নেই।
বেসরকারি শিক্ষকরা যা পান: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলও সরকারিদের সমানই। তবে কেবল মূল বেতনটুকুই সমান, বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন তারা। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বড় অংশই আবার এমপিওভুক্ত নন।
দেশের ২৬ হাজার বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী প্রতি মাসে সরকার থেকে মূল বেতন পান। সঙ্গে দেওয়া হয় নামমাত্র বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা। তাদের বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের শতভাগ বেতন দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় মাত্র এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া। এটি নির্ধারিত।
অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসাভাতা নির্ধারিত মাত্র ৫০০ টাকা। আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা টাইম স্কেল পেতেন। তাও পুরো চাকরি জীবনে মাত্র দু'বার। বর্তমানে টাইম স্কেল বন্ধ।
ঈদ অথবা পূজা-পার্বণে বোনাস হিসেবে সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের শতভাগ পেলেও বেসরকারি শিক্ষকরা উৎসব ভাতা হিসেবে পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা ৫০ ভাগ অর্থ।
জানা গেছে, ১২ হাজার টাকা এবং ১৬ হাজার টাকা স্কেলে নিয়োগকৃত সহকারী শিক্ষকদের পরবর্তী বেতন স্কেল নির্ধারণ করা নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের সরাসরি প্রমোশন এবং বদলিও নেই।
বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো বিভাগীয় ভাতা নেই। দীর্ঘকাল চাকরি করার পর তাদের অনেকটা শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরে যেতে হয়। এককালীন সামান্য অবসর ভাতার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মাসিক পেনশন নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ব্যাপক ব্যয় করতে হয়। তাদের সন্তানদের জন্য কোনো শিক্ষা ভাতা নেই।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (নজরুল) সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় আকাশ-পাতাল বৈষম্য রয়েছে। এ বৈষম্য দূর করা না হলে সার্বিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৮ শতাংশই বেসরকারি খাত। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলায় এ খাতের অবদানই অসীম। তাহলে সুযোগ-সুবিধায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পিছিয়ে থাকবেন কেন?
তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে প্রথম বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্ত হন। সামান্য বেতন-ভাতা নিয়ে যুগ যুগ ধরে শিক্ষকরা পাঠদান করে আসছেন। ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ছিল প্রায় ৩৫ বছর। এখন এক হাজার টাকা হলেও তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ অবস্থার অবসান জরুরি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই