ঢাকা : স্কুল ও কলেজের শাখা ক্যাম্পাস আর থাকছে না। প্রত্যেক ক্যাম্পাসই হতে হবে স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে, তারা ওই নামেই পৃথক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিতে পারবে। কাছাকাছি নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি বা প্রতিষ্ঠানপ্রধান সবই হতে হবে পৃথক। কারও সঙ্গে কারও কোনো সংযোগ থাকবে না।
এসব বিধান রেখেই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালা জারি হলে শাখা ক্যাম্পাস বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো।
উদাহরণস্বরূপ, রাজধানীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি ক্যাম্পাস রয়েছে। নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেইলি রোড; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ধানমন্ডি এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বসুন্ধরা হিসেবে পৃথকভাবে পরিচালিত হবে। তাদের পৃথক অনুমোদন, এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ইআইআইএন) ও আলাদা গভর্নিং বডি থাকবে।
[218701]
সূত্র জানায়, শাখা ক্যাম্পাস থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্প্রতি নানা ধরনের জটিলতা বেড়েছে। পড়ালেখার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ভর করেছে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানগুলো কবজায় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় সরকার শাখা ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনায় নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য গভর্নিং বডি প্রবিধানমালায় শাখা ক্যাম্পাসকে পৃথক প্রতিষ্ঠান করার কথা বলা হয়েছে। এ প্রবিধানমালা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হলে আমরা শাখা ক্যাম্পাসকে পৃথক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নেব।’
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে যাদের শাখা ক্যাম্পাস আছে, তাদের আমরা বলেছি, পৃথকভাবে অনুমোদন নিতে। অনেকেই একে স্বাগত জানিয়ে আবেদনও করেছেন।’
জানা যায়, শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের বড় প্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল। তাদের প্রত্যেকেরই তিন থেকে পাঁচটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের ওপর।
[218695]
তারা শিক্ষার্থী ভর্তি, শাখা বদলি, শিক্ষক নিয়োগ, কেনাকাটাসহ সব খাতে দুর্নীতি করছে। আর সব শাখা মিলিয়ে একজন অধ্যক্ষ থাকায় দুর্নীতি যেমন বেশি হচ্ছে, তেমনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়ও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুরের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের মিরপুর ৬০ ফুট সড়কের পাশে বালক ক্যাম্পাস, বালিকা ক্যাম্পাস, রূপনগর শাখা, শেওড়াপাড়া শাখা ও ইব্রাহিমপুর শাখা রয়েছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানের একজনই অধ্যক্ষ। গভর্নিং বডিও একটা। কিন্তু প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের হিমশিম অবস্থা। এমপিওভুক্ত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ট্রাস্ট বানানোর পাঁয়তারা করছে একটি সিন্ডিকেট।
সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা (ডিআইএ) অধিদপ্তরের এক তদন্তে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কয়েকশ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ওই সিন্ডিকেট যে কোনো উপায়ে প্রতিষ্ঠানটি দখলের চেষ্টা করছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি ক্যাম্পাস। প্রতিটি ক্যাম্পাসে অভিযোগের শেষ নেই। যিনিই অধ্যক্ষ হন তিনিই টাকা কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সম্প্রতি আজিমপুর ক্যাম্পাসের গণিত শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। অথচ মূল ক্যাম্পাসে বসে অধ্যক্ষ ও শিক্ষক প্রতিনিধি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকেন। আজিমপুর ক্যাম্পাসে একজন শাখাপ্রধান থাকলেও তিনি অধ্যক্ষের চাপের মুখে অসহায় হয়ে পড়েন।
এ ছাড়া অবৈধ ভর্তি, শাখা বদলি ও কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকার অনিয়ম হয়।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের তিনটি ক্যাম্পাস। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মূল ক্যাম্পাসে বসে শাখা ক্যাম্পাসেও ছড়ি ঘোরান। অবৈধ ভর্তি এ প্রতিষ্ঠানের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সম্প্রতি এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে গভর্নিং বডির সভাপতি করায় এ বছর অবৈধ ভর্তির অভিযোগ ওঠেনি।
এ ছাড়া রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক ক্যাম্পাস রয়েছে। যারা ইতিমধ্যে প্রত্যেক ক্যাম্পাসকে পৃথক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নিয়েছেন। এর মধ্যে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। তারা পৃথক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেওয়ায় সফলভাবে পরিচালনা করছে।
এ ছাড়া সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক ক্যাম্পাস থাকলেও তারা প্রতিটি ক্যাম্পাসকেই পৃথক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাইলস্টোন, ক্যামব্রিয়ান বা সাউথ পয়েন্টের মতো স্কুলগুলো সম্পূর্ণ বেসরকারি নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রত্যেক ক্যাম্পাস পৃথক অনুমোদন নিয়ে চললেও তা সুন্দরভাবেই চলছে। কিন্তু ভিকারুননিসা, মনিপুর বা আইডিয়াল স্কুল এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এ তিনটি স্কুল থেকে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হয়। যার সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা জড়িত। তাই তারা কোনোভাবেই চাইবেন না, ক্যাম্পাসগুলো আলাদা প্রতিষ্ঠান হোক আর এতে তাদের কর্তৃত্ব হাতছাড়াও হবে।
তবে শাখা ক্যাম্পাস পৃথক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অভিভাবকরা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যায় প্রধান ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সেই সুযোগে অধ্যক্ষ বা গভর্নিং বডির সদস্যরা ছড়ি ঘোরান। এতে বড় স্কুলগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া প্রত্যেক ক্যাম্পাসে সমভাবে উন্নয়নও হয় না। আমরা চাইব, যত দ্রুত সম্ভব সরকার তাদের এ শুভ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করুক।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই