যেমন আছে স্মৃতির স্মারকগুলো

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ১০:২৯ এএম

ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে গেলেই চোখে পড়ে ভাস্কর্য ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’। সেখানে স্থান পেয়েছে সারি সারি আবক্ষ মূর্তি। পরিসরের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত এই ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ধারণ করেছে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এর সঙ্গে দেশ-বিদেশের শতাধিক ব্যক্তির ভাস্কর্য প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বের মুক্তিকামীদের।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘিরে সহিংসতার মধ্যে ভাস্কর্য চত্বরের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নিহত ১৮ ব্যক্তির যেসব ভাস্কর্য এখানে রয়েছে, সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির, জগদীশ চন্দ্র বসু— কারো মুখাবয়ব দেখে এখন আর চেনার উপায় নেই।

মূল ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধুর তর্জনি এখন ভাঙা। ছোট ছোট ভাস্কর্য ভেঙে পাটাতন থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এর মত বেহাল না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ভাস্কর্যগুলো অনাদরে পড়ে রয়েছে। সেগুলো মেরামতের কোনো উদ্যোগও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী দস্তগীর চৌধুরী বলেন, গত ৫ অগাস্ট ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্য চত্বরে ভাঙচুর চালানো হয়। আমি মনে করি বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এখনও ভাস্কর্য সিরিজটিকে মেরামত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কর্তৃপক্ষের কাছে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ, তারা যেন ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যটির দিকে বিশেষ নজর দেন।

শিল্পকর্ম সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসিমুল খবির ডিউক বলেন, আমি নিজে সরেজমিনে দেখেছি, ভয়াবহ ভাঙচুর হয়েছে। পুনর্গঠন প্রায় অসম্ভব। কারণ এর ভাস্কর শামীম সিকদার জীবিত নেই। তবে একটি বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক পরিকল্পনা করে যতটুকু সম্ভব ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

[239625]

অরক্ষিত ‘রাজু ভাস্কর্য’ : ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু। তার স্মরণে নির্মাণ করা হয় ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য’।

জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল এই রাজু ভাস্কর্য। অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের ‘সাক্ষী’ হয়ে ওঠা ভাস্কর্যটির কোনো যত্ন নেওয়া হয় না।

ভাস্কর্যজুড়ে রয়েছে শ্যাওলা; সাদা রঙের ভাস্কর্যটির অধিকাংশ জায়গা এখন কালচে হয়ে আছে। বেদীতে উঠতেই চোখে পড়ে ধসে পড়া একটি দেয়ালের অংশ, যেটি সিঁড়ির পাশে রেলিং ছিল।

ভাস্কর্যটির মূল অবয়বের নিচে যে পাটাতন রয়েছে, তার পেছনের দিকে খসে পড়েছে টাইলস। সেখানে রঙ কিংবা স্প্রে দিয়ে লেখা হয়েছে বিভিন্ন মতাদর্শ ও রাজনৈতিক স্লোগান।

সরেজমিনে দেখা যায়, চারপাশে লোহার বেষ্টনী ভেঙে এর পাদদেশে নিয়মিত বসবাস করছেন ছিন্নমূল মানুষ। ভাস্কর্যের চারপাশে রাখা হয়েছে তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র।

রাজু ভাস্কর্যের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বলেন, আমরা বরাবরই সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সব ভাস্কর্য সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রস্তাব জানিয়ে আসছি। আগের উপাচার্যরা বিভিন্ন কমিটিও করে দিয়েছিলেন এ বিষয়ে। তবে ভাস্কর্যগুলোর অবস্থা এখনো নাজুক।

তিনি বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা খুবই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ভাস্কর্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কাজ করার একটি প্রস্তাব কর্তৃপক্ষকে দেবে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়নি।

[239634]

মলিন ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ : মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ১৯৮৮ সালে নির্মাণ করা হয় ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে ডাস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্ন্যাকস) চত্বরে ভাস্কর্যটির অবস্থান।

এর বাঁ পাশে রয়েছে কৃষকের অবয়ব। এর সঙ্গে রয়েছে অস্ত্রধারী চার নারী ও পুরুষ যোদ্ধার মূর্তি। এ ভাস্কর্যের অবস্থাও নাজুক। ভাস্কর্যটি সাদা রঙের হলেও শেওলা ও ময়লা লেগে কালচে হয়ে গেছে। ভাস্কর্যটির সামনে উঁচু বেদী থাকলেও পাকা করা হয়নি।

গত বছরের নভেম্বরে ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্যে কালো কালি লেপে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তখন কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ভালো নেই ‘অপরাজেয় বাংলা’ও : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটির অবস্থান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নির্মিত এ ভাস্কর্যটির বিষয়বস্তু তিন জন দণ্ডায়মান মুক্তিযোদ্ধা।

কালজয়ী এ ভাস্কর্যের বর্তমান অবস্থাও হতাশাজনক। ভাস্কর্যজুড়ে শ্যাওলা জমেছে। কারুকাজ অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে।

পাদদেশে বিভিন্ন ধরনের রঙ ও স্প্রে দিয়ে লেখা রয়েছে বিভিন্ন স্লোগান ও শব্দ। কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় ভাস্কর্যের বেদী পেরিয়ে যে কেউ উঠে পড়তে পারেন ভাস্কর্যের উপরে।

নাসিমুল খবির ডিউক বলেন, ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যানসহ তিনজন শিক্ষক নিয়ে একটি কমিটি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ কমিটি করা হয়। উপাচার্যের উদ্যোগে সে কমিটির মাধ্যমে আমরা সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারি।

ভাস্কর্য ভাঙচুরের এসব ঘটনা কোনো গণবিক্ষোভের অংশ নয়। গণবিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে পুরনো একটি চক্র এসব ঘটিয়েছে, যারা দেশে শিল্পের মুক্ত চর্চা চায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী বলছে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘অপরাজেয় বাংলা’ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে ‘রাজু ভাস্কর্য’ এখন দেশের মানুষের নানা আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষ চাইলেও রাজু ভাস্কর্যের সঠিক পরিচর্যা করতে পারছে না।

আমরা আগে এ বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। এটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই রাজু ভাস্কর্যের পরিচর্যা করা সম্ভব হবে।

প্রক্টর বলেন, উপাচার্য স্যার এ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখছেন। আমরা আগে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ চত্বরের বিষয়ে খবর নিচ্ছি। ভাস্কর্যটি সিটি করপোরেশন নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন, সেটা নিশ্চিত হওয়া পর আমরা সংস্কার করতে পারব।

উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আন্দোলনের পুরো সময়ে কী কী হয়েছে, সেটি দেখার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে।

কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), ভূমি কার্যালয় ও প্রকৌশল বিভাগ মিলে একটি চিত্র তুলে ধরবেন। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

ভাস্কর্যগুলো নিয়মিত পরিচর্যার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চেষ্টা করে দেখব। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কম। সে ক্ষেত্রে অনেক কিছু করতে চাইলেও পারা যায় না।

এমটিআই