ঢাকা : ২০২০ করোনার প্রকোপে থমকে ছিল পুরো বিশ্ব। ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল শোবিজ দুনিয়াও। বিষাদের এ বছরেও শোবিজ অঙ্গনের একাধিক তারকা বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। মৃত্যু মানুষের অমোঘ নিয়তি। ২০২০ সালে চলচ্চিত্র, সংগীত, মঞ্চ ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এসব মানুষের শূন্যতা কখনও পূরণ হয় না।
চলতি বছরে চলে যাওয়া বরেণ্য তারকাদের স্মরণ করেছে সোনালীনিউজ।
ইশরাত নিশাত (১১ জানুয়ারি ১৯৬৪- ২০ জানুয়ারি ২০২০) : দেশের মঞ্চ নাটকের 'বিদ্রোহী কণ্ঠ' ছিলেন ইশরাত নিশাত। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার কণ্ঠ ছিল সবসময় সোচ্চার। চলতি বছর ২০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
আজাদ রহমান (১ জানুয়ার ১৯৪৪ - ১৬ মে ২০২০) : বিখ্যাত সুরকার গুণী সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান মৃত্যুবরণ করেন ১৬ মে। তিনি বাংলা খেয়াল গানের প্রবর্তক ছিলেন। বাংলাদেশে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন বাবুল চৌধুরীর 'আগন্তুক' ছবিতে।
এন্ড্রু কিশোর (৪ নভেম্বর ১৯৫৫ - ৬ জুলাই ২০২০) : ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। ২০২০ সালের ৬ জুলাই সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় এ শিল্পী ‘প্লে-ব্যাক সম্রাট’ হিসেবেও পরিচিত। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। ছয় বছর বয়সে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন তিনি। গুণী এ শিল্পী আমাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্যা জনপ্রিয় গান। স্বীকৃতি হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী’ ক্যাটাগরিতে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া একাধিক বাচসাস পুরস্কার এবং মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা আছে তার ঝুলিতে।
চিত্রনায়ক আব্দুস সাত্তার (২৬ মে ১৯৫৮- ৫ আগস্ট ২০২০): আশির দশকের জনপ্রিয় নায়ক সাত্তার। ১৯৬৪ সালে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’ সিনোমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে ‘রঙ্গিন রূপবান’ সিনেমায় অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সাত্তার। ক্যারিয়ারে তিনি ১১০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ৫ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।
আলাউদ্দীন আলী (২৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ - ৯ আগস্ট ২০২০) : সুর সম্রাট আলাউদ্দীন আলী মারা গেছেন ২০২০ সালের ৯ আগস্ট। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আলাউদ্দীন আলী দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস এবং রক্তের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। ১৯৫২ সালেল ১৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আলাউদ্দীন আলী ছিলেন একাধারে একজন সুরকার, বেহালাবাদক, সংগীতজ্ঞ, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক। সংগীত পরিচালক হিসেবে সাতবার এবং গীতিকার হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
কে এস ফিরোজ (৭ জুলাই ১৯৪৬- ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০) : শোবিজের পরিচিত মুখ অভিনেতা কে এস ফিরোজ মারা গেছেন ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা ২০ মিনিটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও করোনা উপসর্গ ছিল তার। ১৯৪৪ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন এ অভিনেতা। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর মেজর পদে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। নাট্যদল ‘থিয়েটার’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিনয়ে কে এস ফিরোজের পথচলা শুরু। প্রথম অভিনয় করেন ‘দীপ তবুও জ্বলে’ নাটকে। ছোটপর্দার পাশাপাশি বড়পর্দাতেও ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
সাদেক বাচ্চু (১ জানুয়ারি ১৯৫৫ - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০) : করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান জনপ্রিয় অভিনেতা সাদেক বাচ্চু। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। জনপ্রিয় এ অভিনেতার আসল নাম মাহবুব আহমেদ সাদেক। কিংবদন্তি পরিচালক এহতেশামের ‘চাঁদনী’ সিনেমায় তার নাম বদলে সাদেক বাচ্চু রাখা হয়। তিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা, নাটক রচয়িতা, নাট্যনির্দেশক ও ডাক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে সক্রিয় ছিলেন এ অভিনেতা। ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠ খলচরিত্রে অভিনেতা’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
মহিউদ্দিন বাহার (২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭ - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০): ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান অভিনেতা মহিউদ্দিন বাহার। তিনি জনপ্রিয়তা পান ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'ইত্যাদি'র সুবাদে। ১৯৪৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মহিউদ্দিন বাহার। তিনি সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে ২০০৫ সালে অবসর নেন। সরকারি চাকরিজীবী হলেও অভিনয় ছিল মহিউদ্দিন বাহারের নেশা।
স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছোটদের সিরিজ ‘রোজ রোজ’-এ প্রথম অভিনয় করেন মহিউদ্দিন বাহার। এরপর চাকরির পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন সেলিমসহ অনেকের নাটকে অভিনয় করেন। প্রায় ২৬ বছর ধরে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অভিনয় করেন মহিউদ্দিন বাহার। ইত্যাদিতে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে মহিউদ্দিন বাহারের স্বভাবসুলভ সংলাপ সবার নজর কাড়ত।
আলী যাকের (৬ নভেম্বর ১৯৪৪ - ২৭ নভেম্বর ২০২০) : ৭৬ বছর বয়সে চিরবিদায় নিয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। ২৭ নভেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। বার্ধক্য, হৃদরোগসহ একাধিক শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন আলী যাকের। মৃত্যুর আগে করোনায় আক্রান্তও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক। ১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন তিনি। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি নাটকেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন আলী যাকের। তার স্ত্রী সারা যাকের এবং পুত্র ইরেশ যাকের।
নাট্যজন মান্নান হিরা (১৯৫৬- ২৩ ডিসেম্বর ২০২০) : বছরের শেষ দিকে এসে অর্থাৎ বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান বাংলাদেশের পথনাটকের অন্যতম পুরোধা নাট্যজন মান্নান হিরা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর৷ মান্নান হীরার জন্ম ১৯৫৬ সালে, সিরাজগঞ্জ জেলায়। মফস্বল শহর থেকে মাধ্যমিক, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। নাট্যচর্চার শুরু থেকেই তিনি আরণ্যক নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অভিনেতা আব্দুল কাদের (১৯৫১ - ২৬ ডিসেম্বর ২০২০) : জনপ্রিয় অভিনেতা আব্দুল কাদের ৬৯ বছর বয়সে ২৬ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ভারতের চেন্নাইয়ের ক্রিস্টিয়ান মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন ক্যান্সার আক্রান্ত এই অভিনেতা।
১৯৫১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার সোনারং গ্রামে অভিনেতা আবদুল কাদেরের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তিনি সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। পরে জুতা তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান বাটায় যোগ দেন ১৯৭৯ সালে; সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর।
তার অভিনীত মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে– ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই, স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’। টিভিতে তিনি তিন হাজারের মতো নাটকে অভিনয় করেছেন। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী তিনি। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের বহু জনপ্রিয় নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন কাদের।
তিনি হুমায়ূন আহমদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বদিভাই চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। ২০০৪ সালে আবদুল কাদের অভিনয় করেন ‘রং নাম্বার’ চলচ্চিত্রে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে টেনাশিনাস পদক, মহানগরী সাংস্কৃতিক ফোরাম পদক, অগ্রগামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, জাদুকর পিসি সরকার পদক, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড, মহানগরী অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু পদকও পেয়েছেন আবদুল কাদের।
এ ছাড়া ২০২০ সালে শোবিজ দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন আরও অনেকে। সে তালিকায় রয়েছেন চিত্রসম্পাদক আমিনুল ইসলাম মন্টু, প্রযোজক মতিউর রহমান পানু, নায়িকা জবা, অভিনেতা রানা হামিদ, অভিনেত্রী মিনু মমতাজ, সুরকার সেলিম আশরাফ, সংগীত প্রযোজক সেলিম খান, অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী আহমেদ লীনা, সংগীতশিল্পী জবা চৌধুরী, মুভি মোঘল খ্যাত প্রযোজক কেএম জাহাঙ্গীর খান, আনন্দমেলা চলচ্চিত্রের আব্বাস উল্লাহ, চলচ্চিত্র পরিচালক মহিউদ্দিন ফারুকসহ আরও অনেকে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ